বঙ্গনিউজঃ ট্রেনে সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারে যাওয়ার পথ খুলবে আজ শনিবার। অগ্রাধিকারের এই প্রকল্প উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে ১৩ বছরের প্রচেষ্টা সফল হবে। চালু হবে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার শহর পর্যন্ত নবনির্মিত রেলপথ।
এ ছাড়া সরকারপ্রধান উদ্বোধন করবেন অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর অন্যতম মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। সব মিলিয়ে আজ ১৫টি প্রকল্প উদ্বোধন ছাড়াও তিন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন তিনি। কক্সবাজারবাসীর জন্য এ এক মাহেন্দ্রক্ষণ।
আজ রাজধানী ঢাকা থেকে আকাশপথে কক্সবাজার আসবেন প্রধানমন্ত্রী। দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সবুক্তগীন জানিয়েছেন, শনিবার সকালে সরকারপ্রধান প্রথমে কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশনে সুধী সমাবেশে অংশগ্রহণ এবং স্টেশনের উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। এর পর প্রধানমন্ত্রী ট্রেনে চড়ে রেললাইন পরিদর্শন করে রামু পর্যন্ত যাবেন।
রামু থেকে প্রধানমন্ত্রী মহেশখালী যাবেন। সেখানে তিনি জনসভায় ভাষণ দেবেন। এ জনসভায় রামু, কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, চকরিয়াসহ জেলার প্রতিটি উপজেলা থেকে অন্তত ৩ লাখ মানুষ সমাগমের প্রস্তুতি নিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা ১৫টি প্রকল্প হলো– ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন, ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপারক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, ৬৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে কুতুবদিয়া দ্বীপকে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তকরণ, ৪৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁকখালী নদীর ওপর কস্তুরাঘাট-খুরুশকুল সংযোগ সেতু, ২৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরের ভূমি ভরাট, প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ, অ্যাপ্রোচ রোড ও সৌন্দর্যবর্ধন কাজ, উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ডিজাইন ও স্থাপনকরণ, মহেশখালী গোরকঘাটা-শাপলাপুর জনতা বাজার সড়ক মজবুত ও প্রশস্তকরণ, কুতুবদিয়ায় কৈয়ারবিল আরসিসি গার্ডার ব্রিজ, চকরিয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল হামিদ পৌর বাস টার্মিনাল সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, ঈদগাঁও জাহানারা ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন, মহেশখালী ইউনুচখালী নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ, উখিয়া রত্নাপালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় একাডেমিক ভবন নির্মাণ ও মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ। ২৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে রামু কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রকল্পটি উদ্বোধনের তালিকায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাদ পড়েছে।
যে তিন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে, সেগুলো হলো– ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে টেকনাফ মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার রিসিলেন্ট শেল্টার কাম আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণ ও ২৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে রামু উপজেলা জোয়ারিয়ানালা-নন্দাখালী সড়কে ১৮৪ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ। ১৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার সদরে কাব স্কাউটিং সম্প্রসারণ (চতুর্থ পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণ। একই সময় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের টার্মিনাল-১ নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা থাকলেও সেটি হচ্ছে না।
তবে অন্য প্রকল্পগুলোর তুলনায় সাধারণ মানুষের বেশি আগ্রহ কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত রেলপথ নিয়ে। কারণ, ঢাকা থেকে পর্যটনের শহরে ট্রেনে যেতে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন অনেকেই। রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান জানান, আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে বহু প্রতীক্ষার যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে। ইতোমধ্যে ট্রেনের সময়সূচি ও ভাড়া নির্ধারণ হয়েছে।
জানা গেছে, এই রুটে দুটি ট্রেন চালানোর প্রস্তাব থাকলেও শুরুতে দৈনিক একটি আন্তঃনগর ট্রেন চলবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ১৫১ কিলোমিটার। তবে পথে সাতটি সেতু থাকায় পন্টেজ চার্জসহ ২০৫ কিলোমিটার দূরত্ব ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৩২১ কিলোমিটার। পন্টেজ চার্জসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব ৫৫১ কিলোমিটার ধরা হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এই পথের ট্রেনে ভ্যাটসহ ভাড়া হবে ৫১৫ থেকে ২ হাজার ৩৬ টাকা পর্যন্ত। তবে মেইল ও লোকাল ট্রেনে ভাড়া কমবে। যদিও এই শ্রেণির ট্রেন এখনই চালু হবে না।
রেলওয়ে মহাপরিচালকের কার্যালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, দৈনিক একটি ট্রেন ঢাকা থেকে রাত সাড়ে ১০টায় যাত্রা করে ঢাকা বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রাম স্টেশনে বিরতি দিয়ে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে কক্সবাজার পৌঁছাবে। কক্সবাজার থেকে দুপুর ১টায় যাত্রা করে রাত ৯টা ১০ মিনিটে ফিরবে ঢাকায়। ফিরতি পথেও চট্টগ্রাম এবং ঢাকার বিমানবন্দরে যাত্রা বিরতি করবে। মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে ট্রেনটির।
২০১০ সালে অনুমোদনের সময় দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প সংশোধনে ব্যয় বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে খরচ ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। কক্সবাজার-ঘুমধুম ২৮ কিলোমিটার রেলপথ মিয়ানমারের আপত্তিতে এখনও নির্মাণ শুরু করা যায়নি।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার আগমনকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। মতবিনিময় করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এসব মতবিনিময় সভায় উপস্থিত থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজ থেকেই মাতারবাড়ীর উন্নয়ন দেখতে এখানে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছেন।
কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি নজিবুল ইসলাম বলেন, সকালে প্রধানমন্ত্রী প্রথমে শহরতলির ঝিলংজায় নির্মিত আইকনিক রেলস্টেশন উদ্বোধন করবেন। পরে ট্রেনে চড়ে রামু যাবেন। সেখানে কক্সবাজার শহর, সদর উপজেলা এবং রামুর মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যাকে স্বাগত জানাবেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে জেলার সর্বত্র উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের এমপি আশেকউল্লাহ রফিক বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর জনসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা খুব ভাগ্যবান। এখানে প্রধানমন্ত্রী দেশের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। এ জন্য মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় দুই দ্বীপ উপজেলার লাখ লাখ মানুষ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ যোগ দেবেন।’
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের এমপি জাফর আলম বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী উপজেলায় অনুষ্ঠেয় প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় আমার নির্বাচনী এলাকা থেকে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ যোগ দেবেন বলে আশা করছি। এ জন্য চকরিয়া, পেকুয়া ও মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলার ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরা প্রস্তুতি নিয়েছেন।
কক্সবাজার-৩ আসনের এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, ‘কক্সবাজারবাসীকে না চাইতে দুই হাত ভরে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই এবার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পালা। আমার নেতৃত্বে প্রায় ২০ হাজার মানুষ মহেশখালীতে প্রধানমন্ত্রীর জনসভা সফল করতে যোগ দেবে।’
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তা দলের সদস্যরা শহরে পৌঁছেছেন জানিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে পুরো জেলায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছে।