,
কৃষকবান্ধব নীতি প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশে কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরের লক্ষ্যই হচ্ছে কৃষিকে আধুনিকায়ন করে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করা। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে নানান কৃষিপণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, উল্লেখযোগ্য কৃষিজাত রপ্তানিপণ্য হলো পাট ও পাটজাত দ্রব্য, সুগন্ধি চাল, শাকসবজি, ফলমূল, নানা রকম মসলা, তামাক, ড্রাই ফুডস প্রভৃতি। গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) এসব কৃষিপণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৯৫৮ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের রপ্তানির একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল সুগন্ধি চাল। বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানির প্রধান গন্তব্য হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চল। এসব দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীরা হচ্ছেন মূল ভোক্তা।
আমদানি-রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণে কৃষিপণ্যের রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। বিদেশে বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের রয়েছে প্রচুর চাহিদাও। প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও মানসম্মত পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার ফলে বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ১২ বছর আগেও কৃষিপণ্যের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৪০ কোটি ডলার। কিছু ব্যতিক্রম বিবেচনায় না নিলে গত ছয় বছর খাতটির রপ্তানি আয় দ্রুত বাড়ছে। বিগত সময়ে বাংলাদেশ থেকে যে ১০০ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের অংশই বেশি।
পৃথিবীর অনেক দেশেই যথেষ্ট পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদিত হয় না এবং তারা মূলত আমদানিনির্ভর। তাই আগামী দিনে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের চাহিদা আরও বাড়বে। এ কারণে কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়াতে হলে আমাদের দেশের কৃষিকে আরও বেশি উৎপাদনমুখী ও রপ্তানি বহুমুখীকরণ হতে হবে।
কৃষিপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে অন্যতম হলো পণ্য রপ্তানির জন্য বিমানে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় জায়গা না পাওয়া। এ ছাড়া বিভিন্ন পণ্যের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করার জন্য পরীক্ষাগারের অভাব, ফাইটোস্যানিটারি (আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কৃষিপণ্যের স্বাস্থ্যমান যাচাই) সনদ প্রাপ্তি, দুর্বল প্যাকেজিং ইত্যাদি। কৃষিপণ্য রপ্তানিতে দীর্ঘদিন থেকে একটি বড় বাধা হয়ে উঠেছে ‘ফিট ফর হিউম্যান কনসাম্পশন’ (মানুষের জন্য নিরাপদ কিনা) সনদ।
বাংলাদেশে এ ধরনের সনদ দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সনদ দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মাছ রপ্তানিতে মৎস্য অধিদপ্তর, মাংস ও পশুজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
উৎপাদন পর্যায়ে ১৮১টি পণ্যের বাংলাদেশ মান অনুযায়ী সনদ দেয় বিএসটিআই এবং মধ্যপ্রাচ্যে পণ্য রপ্তানিতে হালাল সনদ দেয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিরই আমদানিকারক দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত ‘ফিট ফর হিউম্যান কনজাম্পশন’ সনদ দেওয়ার সক্ষমতা নেই।
এ অবস্থায় রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আন্তর্জাতিক মানসম্মত অ্যাক্রিডিটেড পরীক্ষাগার স্থাপনসহ মান নির্ধারণী একটি একক ‘হেলথ সার্টিফিকেশন অথরিটি’ প্রয়োজন। দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করে এ–জাতীয় সনদ দেওয়া সম্ভব হলে রপ্তানি বেড়ে প্রতিবছর ১৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ফাইটস্যানিটারি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি মন্ত্রণালয় ঢাকার পূর্বাচলে দুই একর জমিতে স্থাপন করতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানসম্মত অ্যাক্রিডিটেড পরীক্ষাগার। মূলধারার সুপারশপে কৃষিপণ্যের সরবরাহ করতে সরকার উত্তম কৃষিচর্চার আওতায় কৃষিপণ্যের সন্ধানযোগ্যতা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
কৃষিপণ্য রপ্তানি উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় করণীয়গুলোকে চিহ্নিত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে কৃষিপণ্য রপ্তানি খাতকে লাভজনক ও আস্থাপূর্ণ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন করে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার ওপর আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বৈশ্বিক মান অনুসারে খাদ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মানসম্মত পণ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হলে কঠোর বিধিমালা ও দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন।
সারা পৃথিবীতে তাজা কৃষিপণ্যের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমে যাচ্ছে; কিন্তু বাড়ছে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের চাহিদা। উন্নত বিশ্বে এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রেডি টু ইট বা রেডি টু কুক পর্যায়ের খাদ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ছে। সুতরাং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে এখনই প্রাধান্য দিয়ে উন্নত করতে হবে। এই লক্ষ্যে কৃষিপণ্য হতে বৈচিত্র্যময় ও চাহিদাসম্পন্ন খাদ্যসামগ্রী উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। বিশ্ব উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। উৎপাদন পর্যায়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে পেঁয়াজ, সবজি ও ধান।
একইভাবে পেয়ারা ও আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। উৎপাদন ও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত গবেষণার অভাবে এসব পণ্য থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রক্রিয়াজাত পণ্য বাজারজাত করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। নির্দিষ্ট ও গতানুগতিক কিছু পণ্যের মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
পৃথিবীর কোন দেশে কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা রয়েছে, তা জানতে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলো উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের কয়েকটি ব্র্যান্ড যেমন প্রাণ ও স্কয়ার ইত্যাদির প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় বর্তমানে এই খাতের বাজার বিস্তৃতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি নীতি ২০২১-২৪ এ কৃষি ও কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকে সর্বাধিক অগ্রাধিকারের জন্য অন্যতম খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিল্পনীতি ২০২২–এ এই খাতকে রপ্তানি বহুমুখীকরণের অন্যতম খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২১-২৫-এ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির কৌশল বাস্তবায়নের জন্য বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে।
২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হলে কৃষিপণ্য সরকারের নগদ প্রণোদনা ও বিভিন্ন দেশের দেওয়া রপ্তানি সুবিধাগুলো হারাবে বলে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বাস্তবতায় আধুনিক পরীক্ষাগারে খাদ্যমান নিশ্চিত করা, বিশেষায়িত হিমাগার অবকাঠামোর ঘাটতি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে অপর্যাপ্ত গবেষণা ও বাজারজাতকরণে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব দূর করার মাধ্যমে এই বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
কৃষিখাতের খাতের রপ্তানি বহুমুখী করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে তৈরি পোশাক ও প্রবাসী আয়ের নির্ভরতা কমিয়ে আনা যেতে পারে। উত্তরণ পাওয়া যেতে পারে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ‘ডাচ রোগ’ (একটি মাত্র পণ্যের ওপর অতিনির্ভরতা) থেকে।
তথ্যসূত্র: মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক।