বয়ঃসন্ধিকাল ছেলে ও মেয়ে উভয়ের শরীর ও মনে নানা ধরণের পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ে ছেলেমেয়েরা যেমন দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে। তেমনি তাদের চিন্তা চেতনায় দেখা দেয় ব্যাপক পরিবর্তন।ইউনিসেফের সবশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩ কোটি ৬০ লাখ ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। যারা এদেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ।অথচ তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার দিকটি বাংলাদেশে এখনও উপেক্ষিত থেকে গেছে।এ অবস্থায় পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
বয়ঃসন্ধিকাল কখন শেষ হয় - ১৯ না ২৪ বছরে?প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কেন সামাজিক জড়তা?না বুঝেই যৌন সম্পর্কে জড়াচ্ছে কিশোরীরা, বলছেন শিক্ষক যৌন শিক্ষা: বাংলাদেশে কী পড়ানো হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে শারীরিক পরিবর্তন:বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১০ বছর এবং ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়টাকে কৈশোর বলে। এর যে কোন এ সময়ে বয়ঃসন্ধিকাল আসতে পারে। এটা মূলত কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী পর্যায়।অনেক সময় ১৯ বছরের পরও বয়ঃসন্ধির ব্যাপ্তি থাকতে পারে। যা বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনের ওপর নির্ভর করে।চিকিৎসকদের মতে, মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল, ছেলেদের চাইতে কিছুটা আগে শুরু হয়। মূলত ১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে যেকোনো সময় তা হতে পারে।অন্যদিকে ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকাল আসে ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে।এ বয়সে মেয়েদের উচ্চতা বাড়ে। শরীরের বিভিন্ন অংশ স্ফীত হয়। বাহুমূল ও যৌনাঙ্গে লোম গজায়। মাসিক শুরু হয়।
তেমনি ছেলেদের ক্ষেত্রে, এসময় তাদের দেহের উচ্চতা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে, গলার স্বর ভারি হয়ে আসে, কাঁধ চওড়া হয়, পেশী সুগঠিত হয়। মুখে দাড়ি-গোঁফ ওঠে সেইসঙ্গে শরীরের নানা জায়গায় বিশেষ করে, বুকে, বাহুমূলে ও যৌনাঙ্গে লোম গজায়। এই সময়ে ছেলেরা একটু বেশি ঘামে।বয়ঃসন্ধির এই সময়টা ছেলে মেয়ে উভয়ের প্রজনন ক্ষমতা বিকাশ হতে থাকে বলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ হয়।অনেক সময়ে ঘুমের মধ্যে ছেলেদের বীর্যস্খলন হয়ে থাকে। যা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটি বয়ঃসন্ধির একটি লক্ষণ।বয়ঃসন্ধিকালীন এই সময় থেকে ছেলে-মেয়েদের আত্মপরিচয় গড়ে উঠতে শুরু করে বলে জানিয়েছে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার।আত্মপরিচয় বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে, তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা তৈরি হয়। তার কী পছন্দ-অপছন্দ, সে কী চায়। এছাড়া নিজের জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এবং তারা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন মানুষ হিসেবে জীবনের এই পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “শৈশবে তারা যেমন মা বাবা যা বলতো তাই করতো, তাই ভাবতো। কিন্তু এই বয়ঃসন্ধির সময় তারা স্বাধীনভাবে সবকিছু ভাবতে শুরু করে। সে কী পরবে, কী খাবে, কাদের সাথে মিশবে সেটা সে নিজে সিদ্ধান্ত নেয়। যা তার পরিবারের থেকে আলাদা হতে পারে। এজন্য বা মায়ের সাথে তাদের দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। ভালমন্দের একটা কনসেপ্ট তৈরি হয়, যদিও সেটাকে খুব পরিপক্ব বলা যাবে না। ”
ছোট থেকে বড় হওয়ার এই সময়টাতে বড় ধরনের মানসিক ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিতে হয় এই ছেলে মেয়েদের।এ সময় তাদের মধ্যে হরমোনাল কারণে আবেগের প্রাবল্য দেখা দেয়। মুড সুইং হয় বা মন মেজাজ খুব দ্রুত ওঠানামা করে।আনন্দ, রাগ, দুঃখের মতো অনুভূতিগুলো তীব্র মাত্রায় দেখা যায়। আজ আনন্দে উল্লাস করলে আরেকদিন মনমরা ভাব থাকে।এ বয়সের প্রাণচাঞ্চল্য ভেতরের সৃজনশীলতার বিকাশে অনেক বড় ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন মিস সরকার।বয়ঃসন্ধিকালে সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।বয়ঃসন্ধিকালে সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।পরিবারের ভূমিকার কেমন হওয়া প্রয়োজন বয়ঃসন্ধিতে থাকা ছেলে মেয়েরা ভীষণ কৌতূহলপ্রবণ হওয়ায় অনেক সময় তাদের বিপথগামী হওয়ার, মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়া, অযাচিত ঝুঁকি নেয়া বা অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে।
আবার এই বয়সটায় স্বাধীন আত্মপরিচয় গড়ে ওঠায় তারা সব কিছু নিয়ে ভীষণ সংবেদনশীল থাকে।তাই তাদের সঠিক পথে রাখতে পরিবারকে কৌশলী ভূমিকা রাখতে হবে বলে জানান তিনি।”এই বয়সটাতে ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের চাইতে বন্ধুবান্ধবদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। অনেকেই বাবা মায়ের বাধা মেনে নিতে পারে না, রেগে যায়। এ বিষয়গুলো বাবা মায়ের পক্ষে নেয়াও কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু তাদের ধৈর্য হারালে চলবে না। তাদের আচার আচরণের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।”এক্ষেত্রে সন্তানের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বা কোনভাবেই সেসব গায়ে তোলা যাবে না। এছাড়া তুলনা করা, ছোট করে কথা বলা যাবে না বলে মনে করেন মিস সরকার।”তার মানে এই নয় যে তারা যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে। বরং সন্তানের পছন্দ, অপছন্দের প্রতি সম্মান জানিয়ে সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে। যেন তার আত্মসম্মানে আঘাত না আসে আবার ভাল-মন্দের ব্যবধানটাও বোঝানো যায়।”
এই বয়সে ছেলে মেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছেন মিস সরকার।”বাচ্চাদের একটু একটু করে ছাড়তে হবে। শিশুদের মতো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তার ব্যাগ চেক করা, মোবাইল চেক করা, ডায়রি খুলে পড়া এসব করা যাবে না। বন্ধুবান্ধবের ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য করা যাবে না। তবে তারা কী করছে, কাদের সাথে মিশছে সেটা অন্যভাবে সুপারভিশন করতে হবে। না হলে তারা বাবা মার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটা হারিয়ে ফেলবে।”শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য পুস্তকে যৌন শিক্ষা বিষয়ক অধ্যায় যোগ করা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য পুস্তকে যৌন শিক্ষা বিষয়ক অধ্যায় যোগ করা প্রয়োজন।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা:
বয়ঃসন্ধিকালে যেহেতু ছেলে মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতার বিকাশ হয়. তাই এই বয়সে সেক্স এডুকেশন বা যৌনশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা বেশ জরুরি বলে মনে করেন মিস সরকার।যেখানে তার এই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের দিকগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা থাকবে। এতে তারা ঘাবড়ে যাবে না।তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মানসিক ও সামাজিক বিষয়ে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে। ছেলেদের যে রাতে বীর্যস্খলন হয়, এটা যে স্বাভাবিক। বা ছেলে-মেয়েরা একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, সেটা তারা কিভাবে হ্যান্ডল করবে সে বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটা দিক নির্দেশনা দিতে পারে। কারও সাথে রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তার পরিসীমা মেনে চলা, আরেকজনের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে সম্মান জানানো, একে অপরের প্রতি সৎ থাকা, এসব বিষয়ে তাদের সচেতন করা দরকার।
বয়ঃসন্ধিকালীন সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ ও যৌনরোগ সম্পর্কে জানা ও প্রতিরোধ করার জ্ঞান থাকা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালে বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে অপুষ্টিতে ভোগে। কারণ স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কে বেশিরভাগ পরিবার সচেতন নয়।তাই এই সময় ছেলে মেয়ে উভয়কে, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, কার্বোহাইড্রেট, জিংক, আয়োডিন, আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন, শাকসবজি, ফলমূল, ডাল, ডিম, দুধ, মাছ, মাংস খাওয়ার পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদরা।সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধুলা ও ব্যায়ামের প্রতি জোর দেয়ার কথাও জানান তারা।
তথ্য সুত্রঃ গবেষণা