সেদিনের মতো আব্বাস উদ্দীন বেশ দমে গেলেন। কিন্তু মাস ছ’এক পরে আবার তিনি ভগবতী বাবুকে বললেন, আচ্ছা একটা এক্সপেরিমেন্ট করেই দেখুন না। যদি বিক্রি না হয় তা হলে আর ইসলামী গান দেবেন না। ক্ষতি কি ?
নাছোড়বান্দা আব্বাস উদ্দীনকে দেখে শেষ পর্যন্ত ভগবতী বাবূ রাজি হলেন। সে দিন পাশের ঘরেই উপস্থিত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আব্বাস উদ্দীন দৌড়ে গেলেন সেই ঘরে । জনালেন , ভগবতী বাবু রাজি হয়েছেন।
সেই দিনই কাজী নজরুল ইসলাম ভর দুপুরে দরজা বন্ধ করে আধ ঘন্টার মধ্যে লিখে ফেললেন তার সেই বিখ্যাত গান – ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। ঠিক পরের দিন লিখলেন আরও একটি বিখ্যাত গান- ইসলামেরই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর। গান দুটিতে সুর সংযোনগ করে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আব্বাস উদ্দীনকে গান দুটি শিখিয়ে দিলেন। যে দিন গান দুটি লেখা হয়ে ছিল ঠিক তার চার দিন পরেই আব্বাস উদ্দীনের কন্ঠে গান দুটিকে রেকর্ড করা হলো। দু’মাস পরেই এলো ঈদ। ঈদের আগেই বাজারে ছাড়া হলো এইচ এম ভির সেই ইসলামিক গানের রেকর্ড । বলাবাহুল্য ,সেই গান দুটি জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেল। আজও তা সমান ভাবেই জনপ্রিয়। এরপরেই কাজী নজরুল ইসলাম এবং আব্বাস উদ্দীন যৌথ উদ্যোগে একে একে বের করলেন অসাধারণ আরও বহু ইসলামী গান। আল্লাহ রসুলের গান দিয়ে বাংলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে জেগে উঠলো এক নতুন উন্মাদনা। আব্বাস উদ্দীন তার নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন – যারা গান শুনলে কানে আঙ্গুল দিতো তারাই কান থেকে হাত সরিয়ে তন্ময় হয়ে শুনতে থাকলো সেই গান। বাস্তবিকই আব্বাস উদ্দীন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক যিনি ইসলামিক গানকে রেকর্ড করে বাণিজ্যিক ভাবে সফল হয়ে ছিলেন। আশ্চর্যজনক এই যে, তার সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সে সময়ে অনেক হিন্দু গায়কও মুসলমান ছদ্ম নাম নিয়ে ইসলামী গান রেকর্ড করা শুরু করে ছিলেন। আবার ক্ষেত্র বিশেষে উল্টো চিত্রও লক্ষ্য করা গিয়ে ছিল।
আব্বাস উদ্দীন ছিলেন রাজনৈতিক দিক থেকে জিন্নাহ পন্থী লোক । দেশ ভাগের পক্ষে তিনি খুবই সোচ্চার ছিলেন। পাকিস্তান গড়ে তুলার পক্ষে তার গান মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্ব অংশে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসাবে চাকুরি করেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় সংগীত সম্মেলনে ,১৯৫৬ সালে জার্মানীতে আন্তর্জাতিক সংগীত সম্মেলনে এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করে ছিলেন।
আব্বাস উদ্দিন আহমেদ মোট ৪ টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই ৪টি চলচ্চিত্রের নাম হলো – বিষ্ণুমায়া (১৯৩২ ),মহানিশা (১৯৩৬ ), একটি কথা ( ১৯৪০ ) ও ঠিকাদার ( ১৯৪০ ) । এই ঠিকাদার চলচ্চিত্রে আব্বাস উদ্দিন একজন কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ধারনা করা হয় যে, তিনি এর চেয়ে বেশি সংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও তা উল্লেখ করা হয়নি। কারণ সেই চরিত্রগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। এ সব সিনেমাতে তিনি গানও করেছিলেন। তখনকার দিনে মুসলমান ব্যক্তির সিনেমা করা ছিল একটা ব্যতিক্রম ঘটনা। তাই হয়তো বিষ্ণুমায়া ছবিতে অভিনয়ের পরও এর ভূমিকা লিপিতে আব্বাস উদ্দিনের নাম ছিল না। এ তথ্যটি সংগৃহীত হয়েছিল কানন বালা দেবীর কাছ থেকে।
সংগীত জগতে তার অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৬০ সালে তিনি মরণোত্তর ”প্রাইড অব পাফরমেন্স “ পুরষ্কার , ১৯৭৯ সালে শিল্পকলা অ্যাকাডেমী পুরষ্কার এবং ১৯৮১ সালে স্বাধীনতা পুরষ্কার লাভ করেন।
আব্বাস উদ্দীন আহমেদ মাত্র ৫৮ বছর বেঁচে ছিলেন। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ১৯৫৯ সালের ৩০শে ডিসেম্বর বুধবার সকাল সাতটা কুড়ি মিনিটে তিনি প্রয়াত হন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলার এই অসামান্য প্রতিভাধর লোকসংগীত শিল্পী, ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট ,বাংলার বুলবুল বলে খ্যাত লোকসংগীত, পল্লীগীতির সুরকার , শিল্পী ও সংগীত পরিচালক আব্বাস উদ্দীনের নাম বাংলার সংগীত জগতের ইতিহাসে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে , থাকবে স্বর্ণাক্ষরে সমুজ্বল হয়ে।
অনুলিখন:
তথ্যঋণঃ
১) আব্বাস উদ্দিন- রহমান ইমরান।
২) আমার শিল্পী জীবনের কথা-আব্বাস উদ্দিন।
৩) আব্বাস উদ্দিন আহমেদ-ড. তপন বাগচী।
৪) বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান- সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত ।
৫) চলচ্চিত্রে আব্বাস উদ্দিন- মোরশেদ হেদায়েদ হোসেন।
৬) উইকিপিডিয়া।
৭) গল্পস্বল্প।