সে দিন কিন্তু আব্বাস উদ্দীন কখনও ভাবেন নি যে, একদিন তিনি কলের গান গাইবেন। গ্রামোফোন রেকর্ডে তিনি গান গেয়ে বাংলার মানুষকে চমক লাগিয়ে দিবেন। এসব তিনি কখনই ভাবেন নি। সেই ঘটনার অনেক বছর পরে গানের টানে ১৯৩১ সালে তিনি কোলকাতায় এসেছিলেন। ছোট বেলায় কলের গান শুনে তিনি অবাক হয়ে ছিলেন। আর এই কোলকাতা শহরেই তিনি গাইলেন তার প্রথম কলের গান। হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানীতে- যাকে বলা হয় এইচ এম ভি রেকর্ড কোম্পানী, সেই রেকর্ড কোম্পানীতে গাইলেন শৈলেন রায় এবং ধীরেন দাসের লিখা দুটি গান। গান দুটি ছিল যথাক্রমে ১) স্মরণ পারের ওগো প্রিয় এবং ২) কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল ঝড়ে গো ।
সকলেই জানেন যে, গানের জগতে তার কখনই কোন ওস্তাদের তালিম ছিল না। গান তিনি শুনে শুনেই গানের সুর তুলতেন। নিজের প্রতিভা বলে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় তিনি গান গাওয়াকে রপ্ত করেছিলেন। অবশ্য কোলকাতায় এসে তিনি ওস্তাদ জমির উদ্দীন খাঁয়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়ে ছিলেন। তা ছোট থেকেই রংপুর এবং কোচবিহার অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গান, খিরল গান, চটকা গান, জারি গান সারি গান, ভাটিয়ালি গান, মর্শিয়া গান ,পালা গান ইত্যাদি বিভিন্ন জনপ্রিয় গান তিনি গেয়ে ছিলেন।
– এ সব গান সম্পর্কে অবশ্য সংগীত বিশেষজ্ঞগণ ভালো বলতে পারেন।
আব্বাস উদ্দীনের লেখাপড়ায় হাতে খড়ি হয়েছিল বলরামপুর ছাত্রবৃত্তি স্কুলে। সেখান থেকে তিনি কিছু দিনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন কোচবিহার জেলা শহরের জেনকিন্স স্কুলে। সেই স্কুলে ভালো না লাগায় পরবর্তী সময়ে তিনি ভর্তি হলেন তুফানগঞ্জ স্কুলে। তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করার পর তিনি ভর্তি হলেন কোচবিহার কলেজে। সেখান থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ভর্তি হলেন রাজশাহী কলেজে। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া তার ভালো লাগেনি। কোন মতে চারমাস থাকার পর তিনি কোচবিহার কলেজে ফিরে আসেন। এখানেই তিনি বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। এখানে একটা মজার তথ্য আছে। সে যুগে বি এ ক্লাসে মুসলিম ছাত্রদেরকে সংস্কৃত ভাষা নিয়ে পড়তে হতো। অন্যদিকে হিন্দু ছাত্রদেরকে পড়তে হতো ফার্সি ভাষা নিয়ে। তা আব্বাস উদ্দীন পড়াশোনায় এতো ভালো ছিলেন যে , সংস্কৃত ভাষার পরীক্ষায় তিনি অসাধারণ রেজাল্ট করলেন। সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতার জন্য তিনি “ কাব্যরত্নাকর” উপাধি লাভ করেন। সে সময়ে তিনি নিজের নামের শেষে “কাব্যরত্নাকর” উপাধিটি লিখতেন। তিনি লিখতেন- আব্বাস উদ্দীন আহমেদ কাব্যরত্নাকর।
কোলকাতায় একদিন কাজী নজরুল ইসলাম –যাকে তিনি কাজীদা বলে ডাকতেন, সেই কাজীদা একদিন বলে ছিলেন, “ নামের শেষে এতো বড় লেজ লাগিয়েছ কেন ? “ সেদিন থেকেই তিনি তার নামের নামের শেষে ”কাব্যরত্নাকর” উপাধী লিখা বন্ধ করলেন। শুধু লিখতেন নাম- আব্বাস উদ্দীন। যাই হোক, বরাবর পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন আব্বাস উদ্দীন। স্কুল জীবনে প্রতি ক্লাসে তিনি সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করে আসছিলেন। সেই তিনি কিন্তু কোচবিহার কলেজে বি এ পরীক্ষা পাশ করেন নি। করতে পারলেন না। বাবা জাফর আলী আহমেদ , যিনি তুফানগঞ্জ আদালতে ওকালতি করতেন, তার কিন্তু ইচ্ছে ছিল ছেলে বি এ পাশ করে ব্যরিস্টার হবেন। কিন্তু বাবার সেই স্বপ্ন সফল হলো না। ছেলে গানের জগতকে জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হিসাবে বেছ নিলেন। গানের জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে তিনি কোলকাতায় আসলেন। কোলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী কেরানি পদে চাকরি পেলেন। একদিকে চললো চাকরি আর একদিকে চলতে থাকলো তার গানের অনুশীলন। বিভিন্ন জায়গায় গানের অনুষ্ঠান আর গানের টিউশনি করা –এ সব পাশাপাশি চলতে থাকলো। দু’বছর পরেই বাংলা সরকারের কৃষি দপ্তরে স্থায়ী কেরানি পদে ভালো বেতনের একটা চাকুরি পেলেন। ইতিমধ্যেই গ্রামোফোন রেকর্ডের দৌলতে লোক সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে আব্বাস উদ্দীনের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক আব্বাস উদ্দীনের গান খুব পছন্দ করতেন। তিনি আব্বাস উদ্দীনকে “ রেকডিং এক্সপার্ট টু দ্য গভর্ণমেন্ট অফ বেঙ্গল “ পদে নিয়োগদান করলেন। এই কোলকাতা শহরেই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসিম উদ্দিন গোলাম মোস্তফা, পঙ্কজ মল্লিক প্রমূখ বড় বড় সব ক্রিয়েটিভ মানুষদের সাথে। এদের মধ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথেই তার ঘনিষ্ঠতা ছিল সব চেয়ে বেশী। একদিন তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে বলেছিলেন- “ কাজীদা, এই যে পিয়ারু কাওয়াল বা কাল্লু কাওয়াল এরা উর্দূ গান গায় ,এদের গান শুনেছি অস্মভব বিক্রী হয়। বেশ জনপ্রিয় গান। এই ধরণের বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না ? আপনি যদি ইসলামী গান লিখেন তা হলে কিন্তু গানের জগতে একটা বিপ্লব হতে পারে। সব শুনে কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, আব্বাস, তুমি ভগবতী বাবুর সাথে কথা বল। এই ভগবতী বাবু হলেন ভগবতী ভট্টাচার্য। এইচ এম ভি গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানীর রিহার্সেল ইন চার্জ। ষাট বছরের ঝানু এক বৃদ্ধ। সব শুনে তিনি তেলে বেগুণে জ্বলে উঠলেন। বললেন, না না, ইসলামী গান একদম চলবে না। আব্বাস , তুমি তো জানো, ওরা মানে মুসলিমরা গান বাজনা পছন্দ করে না। ইসলামী গানের রেকর্ড বের করলে কোম্পানী এতো বড় ঝুঁকি নিতে পারে না। ব্যবসা একেবারে লাটে ওঠে যাবে। ( অনুলিখন-চলবে )