বঙ্গ-নিউজঃ আদাজল খেয়ে মাঠে নামছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব ধরনের বাধা ডিঙাতে তপশিল ঘোষণার আগেই নানামুখী কার্যক্রম শুরু করেছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া দলগুলোর দিক থেকে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা আমলে নিয়েই কৌশল সাজানো হচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ে হামলার শঙ্কা প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। চিঠিতে মাঠ পর্যায়ের এসব কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ইসি সচিবালয় থেকে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের চিঠি দেওয়া নজিরবিহীন। একইভাবে ইসি সচিবালয়ের মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোতে এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। সাধারণত তপশিল ঘোষণার পরই ইসি সচিবালয় থেকে এ ধরনের চিঠি সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়। এবার তপশিলের আগেই এমন তৎপরতা শুরু হলো।
এর আগে গত ৭ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় ইসির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নির্বাচন কার্যালয়ে হামলার শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। ওই সভায় ইসির শীর্ষ কর্তাদের উদ্দেশে তারা বলেছিলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। আগামী ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের কথা বলে আসছে ইসি। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে থেকেই নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়। বর্তমান একাদশ সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি।
এর আগে নির্বাচন কর্মকর্তা ও তাদের কার্যালয়ের নিরাপত্তায় আনসার সদস্য মোতায়েনেরও কথা বলেন। যদিও আনসার মোতায়েনের প্রস্তাব নাকচ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সুপারকে চিঠি দিতে আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছিল ইসি।
ইসি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে দেড় শতাধিক নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। শুধু ভোটের দিনই নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হন ১৯ জন। কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। নবম সংসদের তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ওই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে লাগাতার কর্মসূচি পালন করেছিল। এবারও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঘোষণা দিয়েছেন– যেভাবেই হোক, নির্বাচন হবেই। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে কোনো ভোট এ দেশে হবে না। আগামীকাল বুধবার বিএনপি ঢাকায় সমাবেশ ডেকেছে। সেখান থেকে নভেম্বরজুড়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে তপশিল ঘোষণার পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। নভেম্বরের প্রথমভাগেই তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন একাধিক নির্বাচন কমিশনার। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ঢাকায় ডেকে প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময় করা হয়েছে।
এসব বৈঠকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে ইসি। এরই ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে ভোটার তালিকা, ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপার ও বিভিন্ন প্রকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী মালপত্র নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মাঠ পর্যায়ের ১০টি আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস, প্রতিটি জেলা নির্বাচন অফিস, প্রতিটি উপজেলা নির্বাচন অফিস এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় থানা নির্বাচন অফিসে সংরক্ষণ করা হবে।’
ইসি সচিবালয়ের সাধারণ সেবা শাখার উপসচিব রাশেদুল ইসলামের সই করা চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব অফিসের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে মর্মে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জনস্বার্থে ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মাঠ পর্যায়ের ওই অফিসগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মাঠ পর্যায়ের প্রতিটি কার্যালয়, বিশেষ করে আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস, জেলা নির্বাচন অফিস, উপজেলা নির্বাচন অফিস ও থানা নির্বাচন অফিসে এখন থেকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন ওঠে। পাশাপাশি গত এক দশকের স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ব্যাপক হারে কমতে শুরু করে। এ জন্য বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার সংকটকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এ পরিস্থিতিতে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়। কাগজের ব্যালটের বদলে ১৫০ আসনে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা লাগানো এবং ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স পাঠানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন তারা। শুধু দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, হাওর ও দ্বীপাঞ্চলে ভোটের আগের দিন ব্যালট পাঠানো হবে বলে কমিশনের সদস্যরা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। ইতোমধ্যে আর্থিক টানাপোড়েনের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইভিএম ও সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে ইসি।
সম্প্রতি ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স পাঠানোর সিদ্ধান্তের বিষয়েও পুলিশের তরফ থেকে আপত্তি উঠেছে। এতে সায় দিয়েছেন কয়েকজন জেলা প্রশাসকও। তবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানিয়েছেন, ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার ও বাক্স পাঠানোর পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের শেষ দিন রোববার এ বিষয়ে আপত্তি তোলেন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তারা। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশনের এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেক জটিলতা তৈরি হতে পারে। ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো নিরাপত্তাসহ সময়সাপেক্ষ বিষয়।
তবে ইসি মনে করে, দ্বীপ, হাওর ও পার্বত্য এলাকা বাদে অন্য সবখানে ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো সম্ভব। কারণ, এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় সব এলাকায় ভালো। সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের দিন বিকেলে বা সন্ধ্যায় কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছানো হয়। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ভোটের আগের দিন ব্যালট পেপার কেন্দ্রে নিয়ে যান। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের (৩০ ডিসেম্বর) আগের রাতেই বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে রাখা হয় বলে অভিযোগ করে আসছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, ইসির এসব আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে, তারা অনেকটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি ব্যর্থ নির্বাচনের দিকে হাঁটছে। এটি জাতির জন্য অত্যন্ত হতাশার। তিনি বলেন, এ ধরনের নির্বাচন মানে রাষ্ট্রের কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ এবং জনগণের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। এতে জাতির কী উপকার হবে– এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, নির্বাচন কার্যালয়ে হামলার শঙ্কায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা সরকারকে চিঠি দিচ্ছেন। এ ধরনের নির্বাচন আয়োজনে যে প্রাণহানি ঘটবে, তার দায় কে বহন করবে?
ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, দশম সংসদ নির্বাচনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি শুধু ভোটের দিনেই সহিংসতায় নিহত হয়েছিলেন ১৯ জন। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর তপশিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২৩-এ। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিনও নিহত হন ১৫ জন।