৪০ কোটি টাকা ঠিকাদারের পকেটে

Home Page » প্রথমপাতা » ৪০ কোটি টাকা ঠিকাদারের পকেটে
রবিবার ● ১৫ অক্টোবর ২০২৩


৪০ কোটি টাকা ঠিকাদারের পকেটে
বঙ্গ-নিউজঃ    পরিকল্পনামন্ত্রী ও সুনামগঞ্জ-৩ আসনের এমপি এম এ মান্নানের বাড়ি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে। খোদ মন্ত্রীর বাড়ি এলাকায় কাজ না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। এক কিলোমিটার কাজ করে বিল দেওয়া হয়েছে ৯ কিলোমিটারের। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের শান্তিগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ শহরের ট্রাফিক পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কের মাটির কাজে এমন অনিয়ম হয়েছে। শুধু মন্ত্রীর বাড়ি এলাকা নয়, পার্শ্ববর্তী মদনপুর-দিরাই সড়কের শূন্য থেকে ২৬ কিলোমিটার রাস্তার কাজ না করেই অর্ধেক বিল উত্তোলন করা হয়েছে। ৩০ কোটি ৩৭ লাখ টাকার কাজের মধ্যে কার্যাদেশের ১৮ দিনের মাথায় কাজ শুরু না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের শান্তিগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ ট্রাফিক পয়েন্ট পর্যন্ত পিএমপি কাজের ২৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকার মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ১৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে কাজ না করে ও অবৈধভাবে প্রায় ৪০ কোটি টাকার বিল পরিশোধ করেছে সওজ। নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে এমন পুকুরচুরি করেছে বলে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করেছে।

সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনে কাজ না করে বিল উত্তোলন ও আংশিক কাজ করে পুরো বিল উত্তোলনের সত্যতা মিলেছে। শুধু সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক নয়, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন সড়কে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৩৫ কোটি টাকার কাজে নয়ছয় করা হয়েছে। যে টাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট বিভাগে বন্যা-পরবর্তী সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছেন।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের বাইরেও সিলেটে অনিয়ম চলছে। এর মধ্যে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের গোবিন্দগঞ্জ এলাকার আল আমিন ফিলিং স্টেশন থেকে কাড়াই ব্রিজ পর্যন্ত ডিবিএসটির কাজ একটি। পাম্পের পাশ থেকে মাইলেজ পয়েন্ট ২৭, ২৮, ২৯, ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এ কাজটি পায় নওগাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদ আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড। গত জুন মাসে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। দেড় কোটি টাকার এ কাজ না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করে সওজ। টাকা উত্তোলন শেষ ভাগবাটোয়ারাও করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরেজমিন ওই এলাকা পরিদর্শন করে কাজের কোনো চিহ্ন মেলেনি।

এ বিষয়ে ঠিকাদার আমিনুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার তাঁর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আল আমিন ফিলিং স্টেশনের মালিক রুহুল আমিন বলেন, সড়কে কোনো কাজ চোখে পড়েনি। কাজের যে বরাদ্দ হয়েছে, তাও জানতাম না।

একই সড়কে প্রধানমন্ত্রীর বরাদ্দের পিএমপির ২২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার কাজ পায় এমএনও জেভি নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের আল আমিন ফিলিং স্টেশন থেকে ডাবর পয়েন্ট পর্যন্ত (মাইলেজ পয়েন্ট ২৩ কিলোমিটার থেকে ৪৬ কিলোমিটার) কোনো কাজ হয়নি। অথচ ১২ কোটি ৫১ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। গত ২৩ আগস্ট সওজ সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ফজলে রব্বে বিলটি অনুমোদন করেন। কাজ না করলেও পেমেন্ট সার্টিফিকেটে সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে মতামত দেন।

সবচেয়ে বড় অনিয়ম হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার বরাদ্দের মদনপুর-দিরাই রাস্তায়। পিএমপির এ কাজে ৩০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সওজ। কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সালেহ আহমদ ও কামরুল অ্যান্ড ব্রাদার্স জেভি। গত ১ জুন কার্যাদেশ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। অথচ কাজ শুরু না করেই ১৮ দিনের মাথায় ১৯ জুন ৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করে সওজ। বিলে সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ফজলে রব্বে, সুনামগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আশরাফুল হামিদ ও উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষর করেন। সর্বশেষ ২৪ আগস্ট সওজ ঢাকার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীও বাকি টাকা ছাড় দেন। অথচ কার্যাদেশের চার মাসেও কোনো কাজ শুরু করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

সুনামগঞ্জের আরেকটি বড় কাজ শান্তিগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ ট্রাফিক পয়েন্ট পর্যন্ত ২৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকার কাজ। রাস্তার এক পাশে হাওরের দিকে ‘ব্রিক টো ওয়ালসহ কংক্রিট স্লোপ প্রটেকশন’ নামে এ কাজের কার্যাদেশ হয় জুনে। কাজটি পায় একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সালেহ আহমদ ও কামরুল অ্যান্ড ব্রাদার্স জেভি। স্থানীয় এমপি ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের এলাকা শান্তিগঞ্জ থেকে ট্রাফিক পয়েন্ট পর্যন্ত প্রটেকটিভ ওয়াল নির্মাণ করার কথা। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, দেখার হাওরের সাইনবোর্ডের পাশের এক কিলোমিটারেরও কম এলাকায় ওই ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ বিল উত্তোলন করা হয়েছে ৯ কিলোমিটারের। যার পরিমাণ ১৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। কার্যাদেশের তিন সপ্তাহের মধ্যে গত ২০ জুন বিলে অনুমোদন করেন সংশ্লিষ্টরা। গত ২৪ আগস্ট পুরো টাকাও ছাড় দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে একাধিক ঠিকাদার জানান, ভুয়া মেজারমেন্ট শিট দেখিয়ে বিল প্রস্তুত করা হয়। অর্থবছরের শেষ সময়ের কারণে কাজ না করেই ঠিকাদারদের বিল দেওয়া হয়েছে। এজন্য তারা বাড়তি সুবিধা নিয়েছেন। কিছু প্রকল্প রয়েছে যেখানো কোনো কাজ আর করবে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তারা ম্যানেজ করে বিল নিয়ে গেছে।

কাজের বিল প্রস্তুতকারী সুনামগঞ্জ সওজের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান কথা বলতে রাজি হননি। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে কাজ করেছেন বলে জানান।
অভিযোগের বিষয়ে সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক  বলেন, চার ভাগের এক ভাগ বিল দেওয়া হয়েছে। কাজ না করে পুরো বিল পরিশোধের বিষয়টি মানতে নারাজ তিনি। সরাসরি কথা বলতে চাইলে সময়ক্ষেপণ করে দেখা করতে চাননি ওই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১১:৪০:১৭ ● ২১৩ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ