বঙ্গ-নিউজ: পড়ালেখা শেষে চাকরির মাধ্যমে অনেকের জীবিকা হলেও এখন ফ্রিল্যান্সিংয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে দেশের লাখো তরুণের। তেমনই একজন গাজীপুরের আরিফ হোসেন সিফাত। তিনি স্নাতক সম্পন্ন করার আগেই ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্টে দক্ষতা অর্জন করে ঘরে বসেই কাজ করে দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের অনেক গ্রাহকের। প্রশিক্ষণ দিয়ে স্থানীয় যুবকদেরও কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে সম্প্রতি ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর আরোপ সংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি সার্কুলার নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেখা দেয় বিতর্ক। ব্যক্তিপর্যায়ের ফ্রিল্যান্সারদের কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইটি খাতের পণ্য বা সেবা বিক্রয়কারীদের দুশ্চিন্তা আরও বেশি। কারণ, তাদের রয়েছে শত শত কর্মী, অফিস ভাড়াসহ অন্যান্য ব্যয়। এ বিষয়ে এনবিআর আনুষ্ঠানিক কিছু না জানালেও এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এতে ফ্রিল্যান্সারদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করারোপ করা হলে ক্রমবর্ধমান এই খাত বড় ধরনের হুমকিতে পড়বে। ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটবে প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে চাকরি হারাবেন অনেক কর্মী। কমে যেতে পারে দেশে ডলার আনার পরিমাণ। অনেকেই বিদেশে কোম্পানি খুলে, সেই কোম্পানির অধীনে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করে রাখতে পারেন। এ ছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না এনে হুন্ডির ব্যবহার বাড়বে। এতে আরও বেশি ডলার সংকটে পড়বে দেশ।
আয়কর আইন ২০২৩-এর ১২৪ ধারা অনুযায়ী, সেবা, রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ পাওয়া রেমিট্যান্সের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর আদায়ে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত অনুমোদিত ডিলার ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের পরিচালক (এফইপিডি) মো. সরোয়ার হোসেন গত বুধবার এ নির্দেশনা দেন।
এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর কর কমিশনারের কার্যালয়, কর অঞ্চল-১১ এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন রেমিট্যান্স পলিসি বিভাগে। নির্বাহী পরিচালক বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, প্রাপকের হিসাবে অর্থ পরিশোধ বা জমাকালে ওই পরিশোধিত বা জমাকৃত অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে কর অঞ্চল ১১-এর কোডের অনুকূলে জমা দিতে হবে।
করারোপের বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে ফ্রিল্যান্সিং করা আরিফ হোসেন সিফাত সমকালকে বলেন, আমরা কষ্ট করে দেশে রেমিট্যান্স আনছি। ডলার সংকটের এই সময়ে ফ্রিল্যান্সাররাও বড় ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু এভাবে টাকা কেটে নিলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে অনেকে। তাঁর যুক্তি, মার্কেট প্লেস ফাইবারের সার্ভিস ফি, গিগ প্রমোশনসহ অন্যান্য চার্জ মিলিয়ে মোট আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশই খরচ হয়ে যায়। অন্যদিকে, আপওয়ার্ক মার্কেট প্লেসে কাজের বিড করতে খরচ বেড়ে গেছে অনেক। এখন ১৫ ডলারে ১০০টি কানেক্ট দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। কাজের মানভেদে প্রতি বিডেই এখন খরচ হয়ে যায় ১০-২০টি কানেক্ট। এর পরও কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এ অবস্থায় কর কেটে নিলে আয়ের পরিমাণ আরও কমে যাবে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মাল্টিডিসিপ্লিনারি রিসার্চ ও টিচিং ডিপার্টমেন্ট অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে ফ্রিল্যান্সিংয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মোট ফ্রিল্যান্স কর্মীর মধ্যে ১৬ শতাংশই বাংলাদেশের। আর ২৪ শতাংশ ফ্রিল্যান্সার নিয়ে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে নিয়ে আসছেন ১০ লাখের বেশি ফ্রিল্যান্সার।
সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও) নিয়ে কাজ করা রাজধানীর লালবাগের ফ্রিল্যান্সার সাজ্জাদ হোসাইনের দাবি, দেশে পেমেন্ট গেটওয়ে পেপাল সুবিধা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিল্যান্সাররা তাদের টাকা আনার ক্ষেত্রে ঝামেলায় পড়ছেন। নানাভাবে টাকা আনতে গিয়ে বাড়তি কর দিতে হচ্ছে। এটি সমাধানের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ের ফ্রিল্যান্সারদের ওপর করারোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যারা কাজ করেন, তাদের সংকটটা আরও বেশি। রাজধানীর খিলক্ষেতে অবস্থিত সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিডি টাস্কের পরিচালক তানজিল আহমেদ বলেন, আমাদের মতো যারা প্রতিষ্ঠান চালান, করারোপের ফলে তাদের বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ, খরচ বহন করে কুলিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁর মতে, ১০ শতাংশ কর কেটে নিলে আয় কমে যাওয়ায় কর্মী কমানোর চিন্তা করা লাগতে পারে।
শুধু যে প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকিতে পড়বে এমনটা নয় উল্লেখ করে এ উদ্যোক্তার শঙ্কা, করারোপ করা হলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার আনা কমিয়ে দিতে পারেন অনেকে। সে ক্ষেত্রে বাড়বে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন। এতে আরও বেশি ডলার সংকট দেখা দিতে পারে।
রাজধানীর রামপুরায় অবস্থিত আরেক আইটি প্রতিষ্ঠান বিডিকলিংয়ের চেয়ারম্যান সাবিনা আক্তারের শঙ্কাও একই। তিনি বলেন, কর আরোপের কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত দেশের জন্য নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার মতোই। এটি কখনোই আমাদের রেমিট্যান্সকে উৎসাহিত করবে না। বরং যে টাকাটা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বৈধভাবে দেশে ঢুকছে, তা অবৈধ পন্থায় চলে যাবে।
এই আইটি উদ্যোক্তার মতে, দেশে ডলার সংকট দূর করতে হলে ফ্রিল্যান্সারদের রেমিট্যান্সে কর বসানোর পরিবর্তে সরকার ঘোষিত প্রণোদনাপ্রাপ্তি সহজ করতে হবে। বর্তমানে সরকারের পলিসি হলো, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশনের (বেসিস) সদস্যরা বিটুবি বিজনেসের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ ইনসেনটিভ পাবে, আর ফ্রিল্যান্সার হলে ৪ শতাংশ পাবে। আমরা দেখছি, সত্যিকার অর্থে ফ্রিল্যান্সাররা সুবিধাটুকু পাচ্ছেন না।
হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিএফডিএস)। প্রায় ১০ হাজার ফ্রিল্যান্সারের এই সংগঠনের চেয়ারম্যান ড. তানজিবা রহমান বলেন, আমাদের সঙ্গে এমনকি কোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনা না করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আমাদের সংগঠনের উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আগামী সোমবার বৈঠক করে করারোপ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হবে।
এ বিষয়ে বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, যে পরিপত্র জারি করা হয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠানিক আইটি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পর্যায়ের ফ্রিল্যান্সারের আয় অন্তর্ভুক্ত কিনা, তা পরিষ্কার নয়। কোথাও বলা নেই, ফ্রিল্যান্সারদের আয়ে করারোপ করা হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার করতে, বেসিসের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রোববার চিঠি দেওয়া হবে। কারণ ২০২৪ সাল পর্যন্ত আইটি খাত করের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। এখনই কাউকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, এটি ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের ক্ষেত্র প্রযোজ্য হবে না। তবে রেভিনিউ শেয়ারিং যেমন– ফেসবুক মিনটাইজেশন, ইউটিউব মনিটাইজেশন থেকে যা আয় হবে, তা থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে।
এ বিষয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, যে ধারা উল্লেখ করে এনবিআর কর আরোপের কথা বলেছে, তাতে ফ্রিল্যান্সাররা পড়বেন না। বিষয়টি নিয়ে রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে কথা বলব।