বঙ্গ-নিউজঃ গত দু’দিন ধরে থেমে থেমে হালকা-মাঝারি বৃষ্টিতে কিছুটা আরামেই দিন কাটছিল রাজধানীবাসীর। গতকাল সারাদিন আকাশ ছিল মেঘলা। থেমে থেমে ঝরেছে বৃষ্টি। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই ঝুম বারিধারা। রাত ৯টা থেকে বাড়তে থাকে তীব্রতা। দেড়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চলে বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পরপর হয় বজ্রপাত। কয়েক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে গোটা রাজধানী। কোনো কোনো সড়ক ও অলিগলিতে জমে যায় কোমরসমান পানি। সড়কে জলাবদ্ধতায় মিরপুরে বিদ্যুৎস্পর্শে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত এক শিশু হাসপাতালে।
প্রবল বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে ছোট-বড় নানা যানবাহন। ১০ মিনিটের হাঁটার পথ গাড়িতে যেতে লেগেছে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত। উপায় ছিল না হাঁটারও। ফলে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে।
চলতি বছরের মধ্যে গতকাল বৃষ্টিতে ভোগান্তির মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এটি গত ৬ বছরের মধ্যে রেকর্ড।আবহাওয়াবিদদের ভাষায়, এটি অতিভারী মাত্রার বৃষ্টি। রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় বৃষ্টি চলছিল। মূলত রাত ৯টার পর চলা টানা বৃষ্টির প্রভাব পড়ে রাজধানীজুড়ে।
তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃহস্পতিবার ঢাকায় সামান্য বৃষ্টি হতে পারে বলা হলেও হয়েছে এর উল্টো।
ভারী বৃষ্টিতে ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, মিরপুর, বনানী, ফার্মগেট, তেজগাঁও, মতিঝিল, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। গ্রিন রোডে কোমরপানিতে রিকশা ও মোটরসাইকেল চলতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা জলাবদ্ধতার কথা জানিয়েছেন।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কোথাও কোথাও জমে যায় হাঁটুপানি। ফলে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সবজি পানিতে ভাসতে দেখা যায়। পার্শ্ববর্তী তেজতুরী বাজারের বিভিন্ন গলিতেও জমে যায় হাঁটু পরিমাণ পানি। তলিয়ে যায় দোকানপাট।
শান্তিনগর থেকে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করে একজন লিখেছেন, ‘নদীর নাম শান্তিনগর’। এ ছাড়া মিরপুর রোড, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউর বিভিন্ন অংশ, আসাদগেট, রায়েরবাজার ও হাজারীবাগ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাজুড়ে ঘরেফেরা মানুষের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। দৈনিক বাংলা, পুরানা পল্টন, বিজয়নগর, সেগুনবাগিচা থেকে শুরু করে সংলগ্ন এলাকায় মধ্যরাত পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
রাত দেড়টায় মিরপুরের কালশী এলাকায় শতাধিক গাড়ি পানিতে নষ্ট হয়ে রাস্তায় আটকে থাকতে দেখা গেছে। ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কেও পানি উঠে যায়। স্থানীয়রা জানান, এই এলাকা সাধারণত উঁচু। এখানে ভারী বৃষ্টিতেও এত দিন জলাবদ্ধতা দেখা দেয়নি। সড়কে চলাচলের পথ না রেখে উঁচু বিভাজক তৈরির কারণে পানি সরতে পারছে না বলে জানান তারা।
এদিকে প্রবল সৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় মিরপুরে বিদ্যুতায়িত হয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মিরপুর মডেল থানার সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা-সংলগ্ন হাজী রোডে ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার মো. জসীম উদ্দীন মোল্লা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, ওই এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে বজ্রপাত হলে পানিতে পড়ে বিদ্যুৎস্পর্শে ৪ জন মারা যান। নিহতরা হলেন– গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর খারাট গ্রামের মনোয়ার শেখের ছেলে মো. মিজান (৩০), তাঁর স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫), মেয়ে লিমা (৭ বছর)। তারা রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তির সানোয়ারের বাসায় থাকতেন।
এ ছাড়া নেত্রকোনার কাশিয়াজুলির সাতগাঁও গ্রামের মো. বাবুল মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ অনিক (২০) মারা গেছেন। তিনিও একই এলাকায় থাকতেন। এদিকে নিহত মিজানের ছেলে হোসাইন (৭ মাস) সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ফেসবুকে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, হাঁটুসমান পানিতে পড়ে আছে চারটি লাশ। আশপাশের লোকজন বাঁশ দিয়ে লাশগুলো তোলার চেষ্টা করছেন।
উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও আশপাশ এলাকায় সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপের কারণে শুক্রবার পর্যন্ত মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত থাকবে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছিল। তবে গতকাল সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরবর্তী ৬ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, ঢাকায় সামান্য বৃষ্টি হতে পারে। অথচ রাতভর ভারী বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তরের এমন পূর্বাভাসের সমালোচনা করেছেন অনেকে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর ঢাকায় ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হচ্ছে ২০০৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরে। সেদিন দিনের প্রথম ভাগের মধ্যে ৩৪১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আর ২০০৯ সালের ২৮ জুলাই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয় ৩৩৩ মিলিমিটার। এর পর বেশ কয়েকবার ২০০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া ২০২২ সালে ২৪ ঘণ্টায় ১২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সারাদিনের গড় বৃষ্টিপাত ছিল ৯ মিলিমিটার। তবে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ২৩ মিলিমিটার গড় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তার পর বাকি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এমন বৃষ্টি গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সামান্য বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস বিষয়ে তিনি বলেন, সব এলাকায় ভারী বৃষ্ট হয়নি। আমরা ঢাকাসহ সারাদেশের জন্য পূর্বাভাস দিয়েছিলাম।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকার যে অবস্থা তাতে অতিবৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হবে না– এ ধারণাটাই বরং ভুল। ভুল পরিকল্পনার পাশাপাশি জলাধার-জলাশয় সব শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এখন যতই প্রাতিষ্ঠানিক কাজ চলুক না কেন, হঠাৎ এত বৃষ্টি হলে তা সামাল দেওয়া বর্তমান ড্রেনেজ সিস্টেমের পক্ষে অসম্ভব।
পুরান ঢাকার বংশাল ও বাংলাবাজার, জুরাইন, যাত্রাবাড়ীর কাজলা, গুলশানের শুটিং ক্লাব মোড়, তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, কাকরাইল, বিমানবন্দর সড়কে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পানি জমে থাকার খবর পাওয়া গেছে। ওইসব এলাকা ও রাস্তায় যান চলাচলের গতি কমে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট।
রাত ১১টা ২৬ মিনিটে সমকালের প্রতিবেদক মোটরসাইকেলে ধানমন্ডির উদ্দেশে রওনা হন। তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকা থেকে কারওয়ান বাজার রেলগেট পর্যন্ত যেতেই তাঁর সময় লাগে ৪৯ মিনিট। হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে কোমরপানি দেখা গেছে। পানি উঠেছে রেললাইনেও। ফলে দুটি ট্রেন থেমে ছিল ১০ মিনিট।
রোকেয়া সরণিতে কয়েকশ গাড়ি আটকা পড়ে। এর আধাঘণ্টা আগেই তলিয়ে যায় গ্রিন রোড এলাকা। সড়কে বহু গাড়ি আটকে থাকতে দেখা যায়। নীলক্ষেত, কাঁটাবন, হাতিরপুল এলাকার সড়কেও পানি জমতে দেখা যায়।