বঙ্গ-নিউজঃ পদোন্নতি নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে হতাশা ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ক্যাডার অফিসাররা একই পদে দীর্ঘ দিন আটকে আছেন। পদোন্নতি জটবদ্ধ থাকায় তাদের গ্রেডের পরিবর্তন হচ্ছে না। অতিরিক্ত আইজিপি থেকে পুলিশ সুপার পর্যায়ে ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে মাস তিনেক আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় পুলিশ সদরদপ্তর। সম্প্রতি ওই তালিকা কাটছাঁট করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতে বিভিন্ন পদে ৩৪২টি পদ চূড়ান্ত করা হয়। প্রস্তাবিত তালিকার অর্ধেকের বেশিসংখ্যক পদ অনুমোদন না পাওয়ায় পুলিশের ভেতরে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে। এরই মধ্যে গতকাল সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করে বেশ কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরলেন ঢাকার সব থানার ওসি। তাদের সঙ্গে ছিলেন রাজধানীর আশপাশের জেলার আরও কয়েকটি থানার পরিদর্শকও। তারা বলছেন, অনেকে এই পদে ১২ থেকে ২০ বছর রয়েছেন। এর পরও পদোন্নতি পাচ্ছেন না। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি তোলা হয়। এ ছাড়া চাকরির বয়স এক দশক হলে সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড বদলের প্রস্তাব দেন ওসিরা। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কনস্টেবল থেকে এএসআইতে পদোন্নতির জন্য বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে পদোন্নতির তালিকা অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে বিবেচনা করার দাবি করা হয়। পাস করার পরও পদোন্নতি না পেলে কনস্টেবলদের বারবার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ বিভাগে ৭২০ জন শীর্ষপদস্থ কর্মকর্তার ইন-সিটু প্রমোশন (একই পদে অধিষ্ঠিত এবং পদোন্নতির পরে একই দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা) প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই প্রস্তাবে গ্রেড-১ এর ১৭টি অতিরিক্ত আইজিপি, গ্রেড-২ এর পদ ৩৪টি, ডিআইজি ১৫৭টি, অতিরিক্ত ডিআইজি ২৬১টি এবং এসপি ২৫৩টি পদ চাওয়া হয়েছিল। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এমন প্রস্তাব পাওয়ার পর তা মূল্যায়নে একটি কমিটি গঠন করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি কাটছাঁট করে এসপি পদ ১৫০টি, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৪০টি, ডিআইজি ৫০টি ও গ্রেড-২ এর পদ ২টি অনুমোদন দিয়ে ফের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। অতিরিক্ত আইজিপির ১৭টি পদের বিপরীতে একটিরও অনুমোদন পায়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলার এসপি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পুলিশে পদোন্নতি জটিলতার কারণে হতাশা বিরাজ করছে। এতে কর্মস্পৃহা কমছে। এ ছাড়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক ‘ব্লেম গেম’ বাড়ছে। পদোন্নতির যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা পূরণ না হলে এ জট কাটবে না। নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়িও বন্ধ হবে না। পদোন্নতির কারণে পুলিশের ক্ষোভ কারও কাম্য নয়। এতে ভালো কাজ ব্যাহত হয়। ওপরের দিকে পদোন্নতির জটিলতা কাটলে নিচের দিকেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
পুলিশ সদরদপ্তরের প্রস্তাব অনুযায়ী, পুলিশ সদরদপ্তরের ১৫তম বিসিএস ব্যাচ থেকে ১৬ জন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শককে (গ্রেড-২) অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) পদে পদোন্নতি চাওয়া হয়। এটি অনুমোদিত হলে অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার ছয়জন কর্মকর্তা পুলিশ সদরদপ্তরে এবং অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার ১০ জন কর্মকর্তাকে সিআইডি, পুলিশ টেলিকম, রেলওয়ে ও হাইওয়ে পুলিশ, পিবিআই, শিল্প পুলিশ, সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট (এটিইউ), সারদা পুলিশ একাডেমি, পুলিশ স্টাফ কলেজ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ছাড়া পুলিশ সদরদপ্তরের ১৭তম বিসিএস ব্যাচ থেকে ৩৪ জন ডেপুটি আইজিপিকে অতিরিক্ত আইজিপি, ২২তম ব্যাচের ১৫৭ জন অতিরিক্ত ডিআইজিকে ডিআইজি পদে, ২৪তম ব্যাচের ২৬৬ জন এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত ডিআইজি এবং ২৮ ও ২৯তম ব্যাচ থেকে ২৪৭ জন অতিরিক্ত এসপিকে এসপি হিসেবে পদোন্নতি দিতে প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এসব পদোন্নতি দেওয়া হলে সরকারের বছরে ২ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, পুলিশে বর্তমানে ক্যাডার কর্মকর্তার মধ্যে আইজিপির পদ একটি, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) দুটি, অতিরিক্ত ডিআইজি (গ্রেড-২) ২০টি, ডিআইজি (গ্রেড-৩) ৮৬টি, অতিরিক্ত ডিআইজি (গ্রেড-৪) ২০০টি, এসপি (গ্রেড-৫) ৫৯৪টি, অতিরিক্ত এসপি (গ্রেড-৬) ১ হাজার ২টি ও এএসপি (গ্রেড-৯) ১ হাজার ২২২টি পদ রয়েছে। শুধু অবসর বা মৃত্যুজনিত শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়া হলে বহু কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হবেন। ২০৩০ সাল পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীতে অবসরজনিত শূন্য পদের একটি হিসাব তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়– পুলিশে ২৮ বিসিএসের কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত এসপি হয়েছেন। ওই ব্যাচের ১৮০ জনের ২৫ জন পুলিশ সুপার হন। ২৮ ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ১৩ বছর হয়েছে তারা চাকরিতে যোগদান করেছেন। ২৮ ব্যাচের প্রশাসন, কাস্টমসসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এরই মধ্যে পদোন্নতি পেলেও ভাগ্যের জট খোলেনি তাদের।
জানা গেছে, ক্যাডার অফিসারের পাশাপাশি পুলিশে পদোন্নতি জটিলতা নিয়ে হতাশ নন-ক্যাডার সদস্যরাও। গতকাল সকালে ঢাকায় ডিএমপির ৫০ থানার ওসি ও আশপাশের জেলার ওসি নিজেদের দাবি-দাওয়া বিষয়ে বৈঠক করেন। এর পর বিকেলে তারা মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক থানার ওসি বলেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের দাবি-দাওয়া অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনেছেন।
কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার সদস্যদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে এক সপ্তাহ আগে পুলিশ মহাপরিদর্শকের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসআই ও সার্জেন্টদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা ও পরিদর্শকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেন। এখন পরিদর্শকরা তাদের পোশাকে দুটি পিপস এবং এসআই ও সার্জেন্টরা দুটি স্টারের বদলে একটি পিপস পরতে চান। এ ছাড়া আমাদের সুপারনিউমারারি পদোন্নতি দেওয়া হলে ভালো। এ ছাড়া কনস্টেবলদের পরীক্ষায় একবার পাস করলে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি করেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ধৈর্য সহকারে সব শুনে সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন। দাবির বিষয় আইজিপির কাছে লিখিতভাবে তুলে ধরব।
আরেক থানার ওসি জানান, শূন্য পদে এএসপির ৩৩ শতাংশ পরিদর্শক থেকে নেওয়ার কথা। আর ৬৭ শতাংশ সরাসরি বিএসএস পরীক্ষার মাধ্যমে। তবে পরিদর্শক থেকে এসএসপি যত শতাংশ হওয়ার কথা, নানা কারণে অনেক কম পদোন্নতি পাচ্ছেন।