পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে সুরমস নামের যে জনপদের উল্লেখ রয়েছে ভিএম আগরওয়াল তাকে সুরমা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত প্রাচীন জনপদ শ্রীহট্ট বলে চিহ্নিত করেছেন। দশম শতাব্দীর শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে শ্রীহট্ট মণ্ডলের উল্লেখ রয়েছে।
আধ্যাত্মিক রাজধানী পুণ্যভূমি সিলেট দ্বিতীয় লন্ডন হিসেবে খ্যাত।
অবস্থানঃ
সিলেট বাংলাদেশ সীমানার শেষ পূর্বপ্রান্ত। সিলেটের উত্তরে ভারতের মেঘালয় প্রদেশ, পূর্বে আসাম প্রদেশ, দক্ষিণে মৌলভীবাজার এবং পশ্চিমে সুনামগঞ্জ জেলা। মধ্যযুগে কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার অংশবিশেষ শীহট্ট মণ্ডলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সিলেট অঞ্চলের অধিকাংশ ভূমিই সমতল। স্থানে স্থানে জঙ্গল ও বালুকাময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিলা রয়েছে। এ জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে বহু নদী । যেমন সুরমা, কুশিয়ারা, পিয়াইন, গোয়ইন, সারি, কাপনা, শেওলা ইত্যাদি। রয়েছে হাওর,বিল। বর্ষাকালে হাওরে অনেক পানি থাকে। হেমন্তে হাওরের যে অংশে পানি থাকে সেটাকে বলে বিল। সিলেট জেলার পূর্বদিন ক্রমোন্নত এবং পশ্চিমাংশ নিচু।
নামকরণের ইতিহাসঃ
প্রত্যেক জায়গার নামের ইতিহাস সংগ্রহ করলে ঐ অঞ্চলের অনেক ঐতিহাসিক ও প্রাচীনতত্ত্বের খবর পাওয়া যায়।মুসলমান আমলে এ অঞ্চল সিলহেট নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজ আমলের কাগজপত্রে Silhet বলে উল্লেখ রয়েছে। বিদেশিদের উচ্চারণে শ্রীহট্ট একসময় সিলেট রূপ নেয়।
সিলেট অঞ্চলের নামকরণ নিয়ে বেশ কিছু কথা প্রচলিত রয়েছে। তা হলো-
১. এ অঞ্চলে প্রচুর শিলা বা পাথর পাওয়া যেতো। এসব পাথবের উপর হাট বা বাজার বসতো। এ থেকে এর নাম হয় শিলহট, শিলহট থেকে শিলহট্ট ক্রমে সিলেট নামে রূপান্তরিত হয়।
২. হযরত শাহজালাল (রহ.) যখন তাঁর সঙ্গী নিয়ে প্রথম সিলেট আসেন তখন গৌড়গোবিন্দ রাজধানীর প্রবেশ পথে বড় একটি পাথর ( শিল) ফেলে রাখেন। শাহজালাল শিল হট ( পাথর সরে যা) বলার সাথে সাথে পাথর সরে যায়। এ থেকে নাম হয় শিলহট।
৩. গৌড়ের রাজা গুহক তার কন্যা শীলার নামে একটি হাট স্থাপন করেন। হাটের নাম শিলাহাট। যা পরবর্তীতে শিলহট, একসময় শ্রীহট্ট হয়ে যায়।
এরকম আরো অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে সিলেটের নামকরণ নিয়ে। শ্রী যুক্ত হয়ে সিলেটের অনেক জায়গার নাম রয়েছে যেমন শ্রীপুর, শ্রীরামপুর, শ্রীমঙ্গল, শ্রীসূর্য, রায়শ্রী, লক্ষণশ্রী ইত্যাদি।
সূচনাঃ
সিলেটে সভ্যতার বিকাশ হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে। এখানে বসতির বিস্তার ঘটে বিগত সহস্রাব্দিতে। তার আগে অবিস্তীর্ণ জঙ্গল ও জলাভূমি হিসেবে পরিচয় ছিলো এই ভূখণ্ডের। তৎকালে এদেশে ককেশীয় ও অস্ট্রেলয়েডরা বসবাস করতো। অস্ট্রিকদের পর এদেশে আসে মঙ্গোলীয় জাতির লোক। এরপর পঞ্চম, ষষ্ঠ শতাব্দীতে আসে আর্যরা। মুসলমানরা আসে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। ইসলাম ধর্ম প্রচারের শুরুতেই সপ্তম শতাব্দীতে কিছু মুসলমান চট্টগ্রাম ও সিলেটে বসবাস শুরু করেন।
চতুর্দশ শতাব্দীতে যখন ভারতে মুসলিম রাজত্বের সূচনা হয় তখন সিলেট ছিল অনার্যদের রাজত্ব। গৌড়িয় পাত্র গোষ্ঠী ছিলো সিলেটের রাজা। তৎকালীন সিলেটের রাজার নাম ছিলো গৌড়গোবিন্দ। গৌড়গোবিন্দের বংশধররা পশ্চাৎপদ পাত্র সম্প্রদায় হিসেবে সিলেটে রয়েছে। তারা এখন কাঠ কয়লার ব্যবসার সাথে জড়িত।
ধর্মীয় প্রভাবঃ
প্রত্যেক জাতির অতীত ও বর্তমানের মাঝে নিহিত থাকে ভবিষ্যতের বীজ। যে জাতি তার অতীত সম্পর্কে উদাসীন, সে জাতি আত্মবিস্মৃত। আত্মবিস্মৃত জাতি সভ্যজাতির কাছে মাথা উঁচু করে পরিচয় দিতে পারে না। সিলেটের অতীত ইতিহাস গৌরবময় ও চিত্তাকর্ষক। হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর আগমন এই জনপদকে গৌরবান্বিত করেছে। সিলেটের মুসলমানরা ইসলামের গৌরবময় ধারার ধারক ও বাহক।
সিলেট শহরে হিন্দু ও মুসলমান প্রভাব সবসময়ই ছিলো সমানতালে। ১৩০৩ সালে শাহজালাল সিলেটে বসতি নেন। শ্রী চৈতন্য দেবের পিতৃভূমি হিসেবে ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে এখানে বৈষ্ণবদের আখড়া গড়ে ওঠে। শ্রী চৈতন্য দেবের পূর্বনাম ছিল নিমাই। তাঁর পূর্বপুরুষরা সিলেটের ঢাকা দক্ষিণের অধিবাসী ছিলেন। শ্রী চৈতন্যের পিতা পরবর্তীতে ঢাকা দক্ষিণ ছেড়ে নবদ্বীপে বসবাস করেন। ২৪ বছর বয়সে নিমাই সন্ন্যাসী হন। তারপর দুইবার সিলেট দর্শনে আসেন। ধর্মীয় আচার আচরণে ভিন্নতা থাকলেও হিন্দু মুসলমানী ছিলো গভীর ও মধুর। তৎকালীন বাংলার সুলতান ছিলেন শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ।
ইতিহাসের খোঁজেঃ
সিলেট দীর্ঘকাল বাংলাদেশ থেকে বিযুক্ত ছিলো। ব্রিটিশ আমলের প্রথম শতাব্দীতে সিলেট ঢাকা ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ১৮৭৪ সাল থেকে স্বাধীনতার পূর্বকাল ( ১৯০৫-১৯১২ ব্যতিত) সিলেট বাংলাদেশ থেকে বিছিন্ন ছিলো। ১৯৪৭ সালে গণভোটের পর সিলেট বাংলাদেশে যুক্ত হয়। বিস্তারিত বলতে গেলে, ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা ঢাকা ডিভিশনের অধীনে ছিল। ১৮৭৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সিলেটকে আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৬০ সালে প্রথম সাবডিভিশন বিভাগের প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং ১৮৬৭ সালে সিলেট জেলাকে সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও করিমগঞ্জ এই চার ডিভিশনে ভাগ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ১৮৭৮ সালে সিলেট মিউনিসিপালিটি স্থাপিত হয়। ১৯০৫ সালের অক্টোবরে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হলে সিলেট পূর্ববঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়। আবার ১৯১২ সালে ১ এপ্রিল আসাম পৃথক হলে সিলেট আসামে ফিরে যায়। উল্লেখ্য ১৯৪৭ সালে রেফারেন্ডমের ফলে সিলেটের অংশ করিমগঞ্জ ভারতে অধীনে চলে যায়।
বিখ্যাত আইন-ই-আকবরীতে লেখা রয়েছে সিলেট ৮ টি মহালে বিভক্ত ছিলো। তা হল প্রতাপগড়, বানিয়াচুঙ্গ, বাজুয়া, জয়ন্তিয়া, হাবলি, সতর খণ্ডল, লাউড়, হরিনগর।
আন্দোলন সংগ্রামে সিলেটঃ
ভাষা আন্দোলনঃ ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ এই ২১ বছরের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জাতি লাভ করেছে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি। যার শিকড় প্রোথিত ছিলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। দেশ কাঁপানো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সিলেটের জনগন শুরু করেছিলো আরো ২৫ বছর আগে অর্থাৎ ১৯২৭ সালে। আসাম ব্যবস্থাপনা পরিষদে সিলেটের সদস্যরা আন্দোলন করে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তমদ্দুন মজলিস “পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। একই বছরের ৯ই নভেম্বর কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সভায় মুসলিম চৌধুরী বাংলার পক্ষে প্রবন্ধ পাঠ করেন। সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও আল-ইসলাহ সম্পাদক মুহাম্মদ নুরুল হকও সক্রিয় হয়ে উঠেন বাংলা ভাষার দাবীতে। সংসদের সাথে সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে ১৯৪৭ সালের ৩০শে নভেম্বর মাদ্রাসা হলে আয়োজন করা হয় সুধী সমাবেশের। খ্যাতনামা রস সাহিত্যিক ও অনুবাদক মতিন উদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে সেই সভার মূল আলোচক ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। বিষয়ঃ “পূর্ব পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু হওয়া উচিত”। সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই ভাষণ পরে আল-ইসলাহ ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত চতুরঙ্গ পত্রিকায় প্রকাশ হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ভাষার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সভা হয় ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর। তমদ্দুন মজলিসের মূখপত্র “সৈনিক”-এরও কিছু দিন আগে সিলেট থেকে প্রকাশ হয় সাপ্তাহিক “নওবেলাল”। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মাহমুদ আলীর পরিচালনায় এবং দেওয়ান আজরফের সম্পাদনায় প্রকাশিত নওবেলাল শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে।
১৯৪৮ সালের ১১ই জানুয়ারী পাকিস্থানের যানবাহন ও যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার সিলেটে আসেন। সিলেট মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন আব্দুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে এবং মহিলা মুসলিম লীগ জেলা শাখার সভানেত্রী বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মহিলা প্রতিনিধি দল মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী জানান। সে বছরই সিলেটের মহিলারা পূর্ব পাকিস্থানের মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনের কাছে জোবেদা খাতুন চৌধুরী, সৈয়দা শাহেরা বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, সৈয়দা নাজবুন্নেসা খাতুন, রাবেয়া খাতুন প্রমূখ নারী নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি পাঠান।
১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্থান গণপরিষদে প্রধানমন্ত্রীর বাংলা বিরোধী বক্তব্যের প্রতিবাদে ১১ই মার্চ দেশে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। এর আগে ৮ই মার্চ সিলেটের গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমানে হাসান মার্কেট নামে পরিচিত) তমদ্দুন মজলিস ও জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন একটি সভা আহবান করে।
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই এভাবেই সক্রিয় ছিলেন সিলেটের ভাষা কর্মীরা। নওবেলাল, আল-ইসলাহ ও সুধীজনদের সাহসী ভূমিকায় বাংলার পক্ষে জনমত প্রবল হয়ে উঠে।
মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলনঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটে জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছিল ৪ নং সেক্টর। এই সেক্টরে ছিল ৬ টি সাবসেক্টর।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দায়িত্বশীল সামরিক পদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সিলেটের কৃতি সন্তানেরা।
তাদের মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছেন-
১.জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী (সর্বাধিনায়ক)
২. মেজর জেনারেল আব্দুর রব (চীফ অব স্টাফ)
৩. কর্নেল এ আর চৌধুরী (সহকারী চিফ অব স্টাফ)
৪. মেজর জেনারেল সি আর দত্ত (৪নং সেক্টর কমান্ডার)
৫. মেজর আব্দুল ফাত্তাহ চৌধুরী (চীফ অব স্টাফ দপ্তরে স্টাফ অফিসার)
এছাড়াও সামরিক বিভাগ থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন, ব্রিগেডিয়ার আব্দুল আজিজ, কর্নেল এজাজ চৌধুরীসহ লেঃ কর্নেল, মেজর ও ক্যাপ্টেন পদবীর অনেকেই। ই.পি.আর ও পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন স্বতঃস্ফুর্তভাবে দেশের টানে। বেসামরিক দায়িত্ব পালনেও সিলেটের কৃতি সন্তানেরা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। প্রবাসী সরকারের আইন সচিব ছিলেন হান্নান চৌধুরী। বৃহত্তর সিলেটের সকল এম,এন,এ এবং এম,পি,এ যুদ্ধকালে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন মুজিব নগর প্রশাসনের ‘নর্থ ইষ্ট’ জোনের চেয়ারম্যান। তিনি ৪ এবং ৫ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও কিশোরগঞ্জ মুক্তাঞ্চলের প্রশাসকেরও দায়িত্ব পালন করেন। মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ (সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী) বাংলাদেশের পক্ষে ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি হিসেবে বুদাপেষ্টে শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) ও পূর্ব ইউরোপের দেশসহ বিভিন্ন দেশে সমর্থন আদায়ে নিরিলস কাজ করেছেন। মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী (সাবেক স্পিকার) নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধির দায়িত্ব কৃতিত্বের সাথে পালন করেন।
আরোও অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাদের নিজ নিজ সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের কারণেই মাত্র নয় মাসেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় সহজতর হয়ে যায়। মাত্র ন’মাস যুদ্ধ করে একটা দেশকে স্বাধীন করার ঘটনা পৃথিবীতে বিরল এবং নজিরবিহীন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অঞ্চলের ৬ জন বীরউত্তম, ১২ জন বীরবিক্রম, ১৫ জন বীরপ্রতীক উপাধি পেয়েছেন।
সাহিত্য, সংস্কৃতিতে সিলেটঃ
ঐতিহাসিকভাবেই সিলেটীদের আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি লালন করে আসছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাসের ফলে ভাষারক্ষেত্রে রয়েছে বৈচিত্র্য। সিলেটের রয়েছে এক বৈচিত্র্যময় নিজস্ব বর্ণমালা যা নাগরী লিপি হিসেবে পরিচিত। সিলেটের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উজ্জলতম দলিল লাগরী লিপি। এ রীতিতেই রচিত হয় তৎকালীন উন্নত সাহিত্য।
মধ্যযুগীয় সাহিত্য থেকে আধুনিক সাহিত্য পর্যন্ত সিলেটীদের রয়েছে বিশেষ অবদান।
মহাকবি সৈয়দ সুলতান,মহাকবি শেখ চান্দ, কোরেশী মাগন ঠাকুর, সৈয়দ শাহনুর। মরমি সাহিত্যের শিতালং শাহ, রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা,শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, শেখ ভানু। কথাসাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলী, শাহেদ আলী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। গবেষণায় সৈয়দ মুর্তাজা আলী, দেওয়ান মোহাম্মাদ আজরফ,দ্বিজেন শর্মা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ উল্লেখযোগ্য।
১৮৭৫ সালে প্যারিচরণ দাস প্রকাশ করেন “শ্রীহট্ট প্রকাশ” যা সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র। তারপর শম্ভুনাথ চৌধুরী প্রকাশ করেন “History Of Sylhet”. কাজী মোহাম্মদ আহমদ ১৮৯৫ সালে প্রকাশ করেন “সিলেট দর্পন”। সিলেটে বর্তমানে বেশ কয়েকটি পত্রিকা তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যতা নিয়ে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলো হলো দৈনিক যুগভেরী ( প্রথম প্রকাশ- ১৯৩০), দৈনিক সিলেটের ডাক, সিলেট মিরর, দৈনিক শ্যামল সিলেট, দৈনিক জালালাবাদ, দৈনিক একাত্তরের কথা, দৈনিক শুভ প্রতিদিন দৈনিক সিলেটের দিনকাল, দৈনিক সিলেটের বানী, দৈনিক জাগ্রত সিলেট ইত্যাদি।
দর্শনীয় স্থানঃ
হিন্দুস্থানের পূর্বসীমান্ত পাহাড়, বন, নদী ঘেরা প্রকৃতির রম্য নিকেতন সিলেট। চাপাতা, কমলালেবু ও আগর-আতরের ঘ্রাণে ভরা সিলেটের বাতাস। সিলেটের কাঠ, কমলালেবু ও তেজপাতার কথা এবং শরগঞ্জ ও বিহঙ্গরাজ পাখির বর্ণনা রয়েছে আইন-ই- আকবরী গ্রন্থে। সিলেটে কমলালেবু ও আনারস জন্মে। হাতকড়া,থইকরের জন্য বেশ সুনাম রয়েছে সদর মহকুমায় ভালো তেজপাতা পাওয়া যায়। হাতকড়া থেকে সুস্বাদু চাটনি তৈরী করা হয়। বালাগঞ্জ শীতলপাটি ও বেতের আসবাবপত্রের জন্য বিখ্যাত।
মালনীছড়া, আলীবাহার, তারাপুর, লাক্কাতুরা, কালাগুল,চিকনাগুল চাবাগানসহ সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে জাফলং,তামাবিল, বিছনাকান্দি,রাতারগুল, সাদাপাথর,আলী আমজদের ঘড়ি,ক্বীনব্রিজ ইত্যাদি।
সিলেটের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিঃ
আবহমান কাল থেকে সিলেটে অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করে। এদের মধ্যে চা শ্রমিত আর সাঁওতাল ব্যতিত সকলেই মঙ্গোলয়েড শ্রেণিভুক্ত। চা শ্রমিকদের মধ্যে রেড ইন্ডিয়ান বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মণিপুরি,পাত্র, ত্রিপুরা,হাজং,হালাম,ওঁরাও, খাসিয়া, গারোরা বাস করে। ক্ষুদ্র এই সব গোষ্ঠির রয়েছে স্বতন্ত্র জীবন বৈচিত্র্য, আচার আচরণ, রীতিনীতি।
সিলেটের বিভিন্ন জায়গার নামঃ
সিলেট শহরে বিভিন্ন জায়গার নামকরণে রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও ভিন্নতা। সিলেটের অনেক স্থানের নামকরণ করা হয়েছে শাহজালালের সফরসঙ্গীদের নামানুসারে যেমন
জিন্দাপীর থেকে জিন্দাবাজর, খেসের খাস দবীর থেকে খাসদবীর, কাজী জালাল উদ্দীন থেকে কাজীটুলা, কাজী ইলিয়াস উদ্দিন থেকে কাজী ইলিয়াস, এরকম মধুশহিদ, শেখপাড়া, সিলাম, জালালপুর, গহরপুর, সৈয়দপুর, চান্দভরাং, ফতেহপুর ইত্যাদি। দেব-দেবীর নাম থেকেও করা হয়েছে নামকরণ যেমন দূর্গাপাশা, শঙ্করপাশা, শিবপাশা, রামপাশা, কালীঘাট।
যে স্থানে যে জিনিস বেশি পাওয়া যেতো সে অনুযায়ী নামকরণ যেমন ফুলবাড়ি, তালবাড়ি, তালতলা, আমবাড়ি, গাছবাড়ি, ঝিঙ্গাবাড়ি। জন্তুর প্রাদুর্ভাব - বাঘা,হরিণাপাটি, হরিণখোলা,হাতিখিরা, মহিষখলা। মাছের প্রাচুর্য - চেঙ্গেরখাল, ঘাগটিয়, বোয়ালপুর, বাউসা ইত্যাদি।
উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের একটি প্রধান শহর সিলেট। সুরমা নদীর তীরবর্তী এই শহরটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এই শহরটি ৩৬০ আউলিয়ার শহর হিসেবে পরিচিত।প্রাকৃতিক গ্যাস, বালু, পাথর ও চা শিল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সিলেট। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সিলেটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তথ্যসূত্রঃ
আমার সিলেট - আবুল মাল আবদুল মুহিত
ভাষা সংগ্রামীদের কথাঃ বৃহত্তর সিলেট - তাজুল মোহাম্মদ
হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস- সৈয়দ মুর্তাজা আলী
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি ( সিলেট) - বাংলা একাডেমি
বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস - (যৌথ সম্পাদিত)
উইকিপিডিয়া ও ইন্টারনেট