
বঙ্গ-নিউজঃ রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ার বাসিন্দা মো. ইব্রাহিমের সাত বছরের মেয়ে ইসনাত জাহান রাইদা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে গত ১৮ আগস্ট ডেল্টা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাইদার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) নেওয়ার সুপারিশ করেন চিকিৎসকরা। তবে ডেল্টা হাসপাতালে এ ব্যবস্থা না থাকায় কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও পিআইসিইউ শয্যা না পেয়ে দালালের মাধ্যমে রাইদাকে ভর্তি করা হয় ধানমন্ডির রেনেসাঁ হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে।
মো. ইব্রাহিমের অভিযোগ, রেনেসাঁ হাসপাতালে পিআইসিইউতে পাঁচ দিন রেখে তাঁর সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পিআইসিইউতে যেসব সুবিধা থাকা জরুরি তার অধিকাংশই নেই। পরিস্থিতি দেখে এক দিন পর অন্য হাসপাতালে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে অন্তত পাঁচ দিন থাকতে হবে।
পাঁচ দিন পর রাইদা পরিপূর্ণ সুস্থ না হলেও ছাড়পত্র দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাসায় আনার পর জটিলতা আরও বাড়ে। আবার তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নানা সমস্যা ধরা পড়ে। এর পর তাকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এখানেও পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। গত ২৫ আগস্ট সকালে তার মৃত্যু হয়।
এর আগে ১৮ আগস্ট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ইব্রাহিমের ছেলে আরাফাত হোসেন রাউফ। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী রাবেয়া আক্তার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেনেসাঁ হাসপাতালে ১০টি পিআইসিইউ শয্যা রয়েছে। এখানে বর্তমানে চারজন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা চলছে। এ ছাড়া নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত দু’জন এবং জ্বরের রোগী রয়েছেন দু’জন। অন্যরা বিভিন্ন রোগ নিয়ে ভর্তি। চিকিৎসাধীন ১০ জনের মধ্যে তিনজন শিশু হাসপাতাল থেকে দালালের মাধ্যমে এখানে ভর্তি হয়েছে।
এর মধ্যে একজন বনশ্রীর বাসিন্দা আক্কাস আলীর চার মাসের ছেলে আরশিয়ান আহমেদ। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর শিশু হাসপাতাল গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা বলেন, শিশুর অবস্থা জটিল পিআইসিইউ লাগবে। শিশু হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা নেই। অন্য কোথায় দ্রুত নেওয়ার চেষ্টা করেন। রাজধানীর নিউলাইফ, গ্রিনলাইফ, ঢাকা মেডিকেলসহ প্রায় পাঁচটি হাসপাতাল ঘুরে পিআইসিইউ না পেয়ে রেনেসাঁ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানেই চার দিন চিকিৎসাধীন রয়েছে। এরই মধ্যে ৬০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়ে গেছে আক্কাস আলীর। ওষুধ ও খাওয়া-দাওয়াসহ এ ব্যয় ৮০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
রেনেসাঁ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দালালের মাধ্যমে রোগী বাগিয়ে আনার কথা অস্বীকার করেছে। এ হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুনজুর হোসেন বলেন, রোগী নিজ ইচ্ছাতেই আমাদের হাসপাতালে সেবা নিতে আসেন। জোর করে এখানে কাউকে ভর্তি রাখা হয় না। হাসপাতালটির পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এখানে শয্যা খালি না থাকলে রোগী ভর্তি করা হয় না। মুমূর্ষু কোনো রোগী এলে তাঁকে এখানকার জরুরি বিভাগে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে রোগীকে অন্য সরকারি হাসপাতালে পাঠানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। হাসপাতালের ভেতরে কোনো সিন্ডিকেট সক্রিয় নেই। তবে হাসপাতালের গেটের বাইরে রোগীর স্বজনরা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ছেন। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে সবাই তৎপর।
চিকিৎসকরা বলছেন, মৌসুমি ফ্লু, জ্বর, ডেঙ্গু, ডায়রিয়াতে কাবু রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ। এসব সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে রোগী ও তাঁর স্বজনদের। বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শিশুদের নিয়ে। শেষ সময় হাসপাতালে আসায় জটিলতা বাড়ছে। অধিকাংশ রোগীর আইসিইউ ও পিআইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে। তবে চাহিদার তুলনায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা কম থাকায় মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে ব্যবসা করছেন হাসপাতাল মালিক ও একশ্রেণির চিকিৎসক। দালালের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে নিম্নমানের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউ ও পিআইসিইউর মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন চিকিৎসকরা।
রাজধানীর ১০টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, এতে আসা অধিকাংশ রোগী জ্বর, ডায়রিয়া ও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। অধিকাংশেরই জ্বর, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যথাসহ ঠান্ডাজনিত উপসর্গ রয়েছে। তবে পরীক্ষায় কারও কারও ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও অধিকাংশই মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত বলে জানান চিকিৎসকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বর আসলে কোনো রোগ না– এটা রোগের লক্ষণমাত্র। শরীরে কোনো রোগজীবাণুর সংক্রমণে সাধারণত জ্বর হয়ে থাকে। তবে এখন জ্বর নিয়ে সামান্য অবহেলাতেই ঘটতে পারে বিপদ। তাই জ্বর দেখা দিলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। বিশেষ করে যাদের অন্য রোগ রয়েছে, তাদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
জ্বরের সঙ্গে কমবেশি সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ থাকে। জ্বর যে কারণেই আসুক, অনেকের মধ্য আতঙ্ক দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু কিনা। নমুনা পরীক্ষায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে।
শিশু ডেঙ্গু রোগী সবচেয়ে বেশি ভর্তি বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে দৈনিক এক হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। এর মধ্যে ৪০০-৫০০ রোগীই জ্বর, সর্দি ও নাক বন্ধ হওয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে আসা।
শিশু হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. লুনা পারভীন সমকালকে বলেন, ডেঙ্গু আচরণগত পরিবর্তনের কারণে রোগীর জটিলতায়ও ভিন্নতা এসেছে। এমনকি মাত্র জ্বর এসেছে, সেই বাচ্চাকে বাসা থেকে হাসপাতালে আনতে আনতেই পালস পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার বলেন, এ হাসপাতালে এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপ কিছুটা কমেছে। জ্বর, ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও টাইফয়েডে রোগী বেশি আসছে। অধিকাংশ রোগী দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ শিশু। যাদের পিআইসিইউ লাগছে। তবে চাহিদার তুলনায় দেশে পিআইসিইউ সংখ্যা অনেক কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ডেঙ্গুর যে ধরন দেখা দিয়েছে, আগামী বছর আক্রান্তরা আরও বেশি শকে যাবে। ডেঙ্গু রোগী ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনে কোনো সমস্যা নেই। আগামী বছর অবস্থা আরও খারাপ হবে। কারণ আমাদের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, টারশিয়ারি লেভেলে সংক্রমণ হচ্ছে। এ কারণে বেশি জটিলতা দেখা দিচ্ছে। প্রতিটি সিজনের সংক্রমণ-পরবর্তী সিজনের সংক্রমণকে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করছে। প্লাটিলেট এখানে ইস্যু না, ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট এখানে ইস্যু।
সারাদেশে কত ডেঙ্গু রোগী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তার কোনো পৃথক পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। তবে এ বছর এক লাখের বেশি ডেঙ্গু রোগী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যয়ও বেসরকারি হাসপাতালে অনেক বেশি। তবে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ের হিসাব নেই সরকারের কাছে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সরকারি হাসপাতালে একজন ডেঙ্গু রোগীর পেছনে সরকারের ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু চিকিৎসায় মোট চারশ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে সরকারের। তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এ বছর ডেঙ্গুর পেছনে মানুষের ব্যয় এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা।