বিশেষ প্রতিনিধি, বঙ্গ-নিউজ: চলতি বছরের শেষ দিকে অথবা আগামী বছরের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হতে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন দেয়ার কাজ শুরু করেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চলতি মাসের গেলো ৬ তারিখে গণভবনে বিশেষ বর্ধিত সভায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচন প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদানের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন কারা পাবেন এবং কারা বাদ পড়বেন সে বিষয়েও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে দাবী করেন সভায় অংশ নেওয়া তৃণমূল নেতারা। তারা আরো জানান,সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করতে বলেছেন দলীয় সভাপতি। গুরুত্বপূর্ণ এই বর্ধিত সভায় অংশগ্রহনকারী নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে দলীয় সভাপতি বলেন, দলের উন্নয়ন প্রচার না করে এমপি বা দলের কোন নেতা কি করলো, সেটা নিয়ে লেগে থাকবেন না। এতে দলের বদনাম হয়। আমি পরিষ্কারভাবে বলছি, কাকে মনোনয়ন দেবো, সেটা জরিপ করে দেখছি। এখনো জরিপ চলছে। কার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা আছে, কে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে এসব তথ্য আমার কাছে আছে। আমি দলের সুনাম ক্ষুন্ন হতে দেবনা। ক্লিন ইমেজের প্রার্থী মনোনয়ন পাবেন। সভাপতির এ বক্তব্যকেই মনোনয়নের বার্তা বলে ধরে নিয়েছেন সকল নেতারা।
জানা যায়, সেপ্টেম্বরে সংসদের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। ধারনা করা যায় এরপর থেকেই চূড়ান্ত প্রার্থীদের এলাকায় কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হবে।এরইমধ্যে বেশ কয়েক ধাপে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ এগিয়ে নেয়া হয়েছে।
স্থানীয় দলীয় সূত্র জানায়, ইতিমধ্যেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়ন্দা সংস্থা প্রতি উপজেলায় দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেছে। ঐ বৈঠক থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঠ পর্যায়ে গ্রহণ যোগ্যতা যাচাইকরে কেন্দ্রে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।
এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে প্রার্থীদের। সুনামগঞ্জ-১ আসনেও থেমে নেই প্রার্থীদের তৎপরতা। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিএনপির অবস্থান এখনও অস্পস্ট। তবুও আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ধীরগতিতে বিএনপিও জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। বসে নেই জাতীয় পার্টিও। পাশাপাশি বিকল্পধারা, জামায়াত ইসলামসহ অন্যান্য দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ আসনটিতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই সীমিত থাকবে।
সুনামগঞ্জ-১ আসন যার সংসদীয় আসন নং ২২৪। তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলা নিয়ে গঠিত হলেও সম্প্রতি ধর্মপাশা উপজেলাকে ভেঙে মধ্যনগর নামে আরেকটি নতুন উপজেলা ঘোষণা করায় আসনটি আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন চারটি উপজেলার আসন হওয়ায় সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন প্রত্যাশীও এই আসনে। জেলার পাঁচটি সংসদীয় আসনের মধ্যে এটিই এখন আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় আসন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা যায়, ভোটার তালিকায় সুনামগঞ্জ-১ (ধর্মপাশা, মধ্যনগর, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ) আসনে মোট ভোটার চার লাখ ৯১ হাজার ৫৫৮ জন। এরমধ্যে পুরুষ দুই লাখ ৫২ হাজার ৯৭৩ এবং মহিলা দুই লাখ ৩৮ হাজার ৫৮৫ জন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১৫০টি। এবার খসড়া তালিকা অনুযায়ী ১৬৯টি।
জেলার সর্ববৃহৎ এই আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে লড়তে চান অন্তত ১১ জন প্রার্থী। এই আসনে আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। তাঁর বিরুদ্ধে দূর্নীতির মামলা তদন্ত করছে দূর্নীতি দমন কমিশন (দূদক)। এছাড়াও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য রতনের সাথে চার উপজেলার অধিকাংশ নেতাকর্মীদের সৃষ্টি হয়েছে দূরত্ব। । যে কারণে তাকে মনোনয়ন দিলে দলটি ইমেজ সংকটে পরবে, এ ভাবনায় এবারের নির্বাচনে দল থেকে তিনি বাদ পড়তে পারেন। এ কারণে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তবে রতন ঘনিষ্টরা বলছেন, তিনি এবারও নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন চাইবেন এবং পাবেন। এ পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি করে দলকে চাঙ্গা রাখছেন অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
সুনামগঞ্জ -০১ সংসদীয় আসনটি মূলত আওয়ামী লীগের আসন হিসেবেই বিবেচিত হয়।এ আসনের চারটি উপজেলার মোট ভোটারের প্রায় চল্লিশ শতাংশের বেশি রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায় ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। আর এই বিশাল অংশটি আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোট ব্যাংক হিসেবে সবসময়ই কাজ করে।
এমপি রতন ছাড়াও এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সাবেক ছাত্রনেতা এডভোকেট রনজিত সরকার, সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক শামীমা আক্তার খানম, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি মো: সেলিম আহমেদ, আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির টিম সদস্য ও সাবেক যুগ্ম সচিব বিনয় ভূষণ তালুকদার ভানু, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের জেলা আহবায়ক ড.রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হায়দার চৌধুরী লিটন,জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান সেলিম, ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব খান ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এডভোকেট গোলাম কিবরিয়া।
তবে চার উপজেলার দলীয় নেতা-কর্মীদের অধিকাংশকেই সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট রনজিত সরকার ও জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি মো: সেলিম আহমেদকে সামনে রেখে বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচি পালন সহ নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়। অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঝে সুনামগঞ্জ-মৌলভীবাজার সংরক্ষিত আসনের বর্তমান এমপি হাওরকন্যা খ্যাত শামীমা আক্তার খানমের ব্যক্তিগত পরিচিতি ও সু-সম্পর্ক রয়েছে দলীয় প্রধান সহ আওয়ামীলীগের নীতিনির্ধারকদের অনেকের সঙ্গে।এ ছাড়া তিনিও নিয়মিত এলাকায় গনসংযোগ করছেন।
ক্লিন ইমেজের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বঙ্গ-নিউজকে বলেন, ‘দলীয় প্রধান সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন আগামী নির্বাচনে ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হবে।তাই আমিই মনোনয়ন পাবো বলে আশা করছি।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তেমন তোড়জোড় নেই বিএনপির। অনেকটা ছন্দহারা পরিস্থিতিতে রয়েছে বিএনপি। দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে সাবেক এমপি এবং ওয়ান ইলাভেন এর সংস্কারপন্থী নেতা নজির হোসেনের মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত। এ কারণে এই আসনে বিএনপির অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতৃত্বের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে বলে জানা যায়। তবে
বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন সুনামগঞ্জ জেলা কৃষক দলের সভাপতি ও তাহিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুল হক, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও তাহিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও ধর্মপাশা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালীব খান, প্রবাসী নেতা ব্যারিস্টার হামিদুল হক আফেন্দি লিটন।তবে দলের সকলস্থরের নেতা-কর্মী ও ভোটারদের কাছে সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত নজির হোসেনের মনোনয়ন নিশ্চিত হলে অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীগন অতীতের মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারেন। এতে করে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ের নির্বাচন করতে পারবেনা বলে মনে করেন দলটির তৃনমুলের অনেক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ।
জানতে চাইলে, বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী আব্দুল মোতালিব খান বঙ্গ-নিউজকে বলেন, আমরা এখন আন্দোলনের মাঠে আছি। তবে আমি ‘৯১ সাল থেকে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন চেয়ে আসছি এবং সবচেয়ে সিনিয়র প্রার্থী।এবার আমি দলীয় মনোনয়ন পাবো বলে আশা করছি।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে, ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ মুরাদ বলেন,সুনামগঞ্জ -০১ আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এম্নিতে এ আসনের আওয়ামী লীগে কোনো বিভক্তি নেই।
তবে দুদক মামলার আসামি বর্তমান সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন আমার মতে দলের অভ্যন্তরে এমনকি সাধারণ মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন । আসন্ন নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-০১ আসনে একজন কর্মীবান্ধব, সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পন্ন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত।
নির্বাচন ও মনোনয়ন বিষয়ে মধ্যনগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম মজনু বলেন, সাবেক এমপি নজির হোসেন দলীয় মনোনয়ন পাবেন এটা নিশ্চিত। আর তিনি ছাড়া এ আসনে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করা আর কারো দ্বারা সম্ভব নয়।’