বঙ্গ-নিউজঃ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য সর্বাপেক্ষা গ্লানিময় একটি কালো দিন। এই দিনে নৃশংস ও কাপুরুষোচিতভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। হত্যা করা হয় ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবনে, যেখান থেকে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলার আপামর জনসাধারণকে, তাদের পরম আরাধ্য স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার সংগ্রামে। ঘাতকের বুলেট শুধু বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। অল্পকালের মধ্যেই জেলের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি নেতৃত্ব দানকারী জাতীয় ৪ নেতাকে। এর মাধ্যমে ঘাতক চক্র বাংলার স্বাধীনতার চেতনাকেই চিরতরে বিনষ্ট করতে চেয়েছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মধ্যেই অনেক প্রবীণ রাজনীতিকের মধ্যে বিরাজমান বিভ্রান্তি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু দ্বি-জাতিতত্ত্বের অসারতা অনুধাবন করেন এবং বাঙালি জাতিসত্তার স্বাধীন প্রকাশ ও বিকাশে তৎপর হয়ে ওঠেন। এই সময়েই পুঁজিবাদের অনুসারী নয়া উপনিবেশবাদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন খেলা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে পশ্চিমা বিশ্ব কম্যুনিজমকে প্রতিহত করার অজুহাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে দুটি আঞ্চলিক জোট গঠন করে। একটি হচ্ছে ‘সাউথ ইস্ট এশিয়ান ট্রিটি অর্গানাইজেশন-সিয়াটো’, অপরটি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ‘সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন-সেন্টো’ বা বাগদাদ প্যাক্ট। সেপ্টেম্বর ১৯৫৪-তে গঠিত সিয়াটোর সদস্য ছিল আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান।
সিয়াটো বা সেন্টো বিষয়ে এ পর্যায়ে আর বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে শুধু এতটুকু বলা চলে, ১৯৭০ সালে ভিয়েতনামে আমেরিকার সামরিক পরাজয়ের পরে সিয়াটো এবং ইরানের বিপ্লবের পর সেন্টোর স্বাভাবিক অবলুপ্তি ঘটে। সিয়াটো এবং সেন্টো সম্পর্কে ওপরের সংক্ষিপ্ত আলোকপাত থেকে এটাই প্রতীয়মান, জোট দুটি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের কোনোরূপ স্বার্থ রক্ষা নয় বরং পশ্চিমা নয়া উপনিবেশবাদ এবং এ অঞ্চলে তাদের ওপর নির্ভরশীল কতিপয় স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই পশ্চিমাদের মদদে গঠিত দুটি মেকি জোট ছিল। অবশ্য কোল্ড ওয়ার এবং কোথাও কোথাও প্রক্সি ওয়ারের ঢাল হিসেবে জোট দুটি ব্যবহৃত হয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই জোট দুটি গঠিত হওয়ার সময় থেকেই এই বাস্তবতা দিবালোকের মতো পরিস্ফুট থাকলেও তৎকালীন এদেশীয় প্রবীণ নেতা অনেকেই এই জোটগুলোতে পাকিস্তানের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেননি। বরং সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতা এর প্রতি সমর্থন জানান। কিন্তু বাংলার উদীয়মান নেতা শেখ মুজিব অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে তাঁর এককালের রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পক্ষাবলম্বন না করে এর সরাসরি বিরোধিতা করেন। ফলে তিনি বিরাগভাজন হন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে সম্যক অবহিত জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিব শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সার্থকতার দিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি এমনকি তৎকালীন পূর্ববাংলার প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে বাংলার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তখন শহর-বন্দর গ্রামের সর্বপ্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন জনমানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর হাজতবাসের এক নতুন অধ্যায়। আইয়ুব শাহি তাঁকে যতবার যেখান থেকেই গ্রেপ্তার এবং যে প্রান্তের কারাগারেই পাঠাক; পরবর্তী সময়ে জামিনে বেরিয়ে এসে সেখান থেকেই আবার জনসংযোগ শুরু করতেন। তাঁর এই নিরলস ঝটিকা সফরের ফলে সমগ্র দেশ একেবারে মাঠ পর্যায় থেকে জেগে উঠতে থাকে। দৃঢ়চেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম থেকেই কোনো পর্যায়ে ভীতি, প্রলোভন বা কোনো কিছুর বিনিময়েই শোষক-শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার কোনো লক্ষণ প্রকাশ করেননি। ১৯৭১-এ সম্মুখ সমরে ৭ম নৌবহর বন্দরে ভিড়তে না পারলেও এরাই ১৯৭৪ সালে গমবাহী জাহাজকে বন্দরে ভিড়তে না দিয়ে অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে দেশের ভেতরে কৃত্রিম খাদ্য সংকট, অরাজকতা সৃষ্টিসহ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষাবস্থা তৈরিতে সফল হয়। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও ঘোলা করতে দেশি-বিদেশি চক্র তৎপর হয়ে ওঠে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই তারা চূড়ান্ত আঘাত হানতে সমর্থ হয়। সচেতন পাঠকের নিশ্চয় স্মরণে আছে, দেশের শাসনতন্ত্রের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্রকে বিকৃত করে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নাম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ থেকে সদ্য প্রত্যাবর্তনকারী তরুণ-যুব সমাজের একটি অংশকে অলীক স্বপ্নের জালে বিভ্রান্ত করে একটি নতুন দল গঠন করা হয়। নিত্য-নতুন বিপ্লবী স্লোগান দিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা নৈরাজ্য সৃষ্টিতে তৎপর থাকে। এক পর্যায়ে বেইলি রোডের সুরক্ষিত এলাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে আক্রমণের মতো হঠকারী কাজ করে। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল জনমনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে স্বাধীনতার ভিতকেই দুর্বল করে দেওয়া।
প্রায় একই সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাম্যবাদী আন্দোলনে বিভক্তির পরিণতি আমাদের দেশের একদা শক্তিশালী স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি বামপন্থিদের মধ্যেও বিভ্রান্তি ও বিভক্তি দেখা দেয়। তার ফলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সীমান্তের ঠিক ওপারেই পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদার এবং নক্সালবাড়ী আন্দোলনের প্রভাবে এদেশেও মারাত্মক ধরনের চরম পন্থা অনুসরণের প্রবণতা দেখা দেয়। উপর্যুপরি এসব ঘটনার পরিণতিতে দেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক অস্থিরতার বিপৎসংকেত বেজে ওঠে। এর সুবিধা গ্রহণ করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র দেশের পুনর্বাসন এবং উত্তরণ প্রক্রিয়াকে মাঝপথে বাধাগ্রস্ত করে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করে দেশকে বিপন্ন করে তোলে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মোর্চার একাংশ এবং আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজের অনেকেই তাদের চারপাশে ঘটমান এসব অশনিসংকেত সম্যক উপলব্ধি করতে এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং তার পূর্ববর্তী ঘটনাবলির প্রকৃতির সঙ্গে চিলির জনপ্রিয় রাষ্ট্রপ্রধান সালভাদর আলেন্দের সামরিক অভ্যুত্থানে উৎখাত এবং তাঁর করুণ মৃত্যুর ঘটনাবলির অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় তিনিও ক্ষমতারোহণের অব্যবহিত পরেই জাতীয় স্বার্থে এবং জনকল্যাণে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেশীয় কায়েমী স্বার্থ এবং তাদের মদদদাতাদের বিরোধিতাকে অস্বীকার করে তিনি তাঁর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হন। পরিণতিতে তিনি বরণ করেন করুণ মৃত্যু। এর পর দেড় যুগের অধিককাল চিলির জনগণ পিষ্ট হয় সামরিক শাসনের জাঁতাকলে। আলেন্দের কর্মসূচির ঘনিষ্ঠ সমর্থক বিশ্ববিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা এবং অনেক গুণীজনকে হত্যা করা হয়। ঠিক যেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পুনরাবৃত্তি।
বঙ্গবন্ধুকে তাঁর শিশু সন্তান রাসেলসহ হত্যা করে হত্যাকারীরা এবং তাদের পশ্চাতের কুশীলবরা প্রচণ্ড জিঘাংসার পরিচয় দিয়েছে। এর বীজ নিহিত ইতিহাসের পরতে পরতে। যখন থেকে শেখ মুজিব বাঙালি জাতিসত্তাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে, তখন থেকেই তাঁকে নির্মূল করে বাঙালি জাতিসত্তাকেই অবদমনের চেষ্টা করা হয়েছে বারংবার। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা, আরবি হরফে বাংলা লেখার পরামর্শ, রবীন্দ্র-নজরুল নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি এরই ইঙ্গিতবহ। এসব ঘটনা থেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন এবং করণীয় রয়েছে অনেক কিছু।