সক্রেটিসকে হেমলক লতার বিষপানে হত্যা করেছিল তৎকালীন গ্রীসের শাসক গোষ্ঠী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করছিলেন। কিন্তু গ্রীসে সেই সময়ে এত মহান এক শিক্ষককে এই অভিযোগে বিষপানে হত্যা করা হলেও, বর্তমান সময়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির কিছু নেতিবাচক ব্যবহার করে যুব সমাজকে কুপ্রথা শেখানো, নৈতিকতাহীন ও মূল্যবোধহীন করে তোলার জন্য কোন গুরু বা লঘু শাস্তি প্রদান করা হয় না বললেই চলে। যাযাবর বলেছিলেন,”সভ্যতা দিয়েছে বেগ, নিয়ে গেছে আবেগ”। আমাদের আবেগ ও মূল্যবোধ এখন দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে অবস্থান করছে। বর্তমান সমাজে শিক্ষার্থী ও উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েদের কেমন এক অস্থিরতার মধ্যে থাকতে দেখা যাচ্ছে। অবেগ, অনুভূতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। পৃথিবীতে মানব সূচনা থেকে শুরু করে যখন ১৭৬০ সালের দিকে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়, তখন মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০ কোটি। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর ২৫০ বছরের মধ্যেই সেই মানুষের সংখ্যা বেড়েছে আরও ৪০০ কোটি। বর্তমানে পৃথিবীতে ৮০০ কোটি মানুষের বসবাস। এই অল্প সময়ে এ অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ পৃথিবী কতটা বহন করতে পারছে বা পারবে?
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমরা কোন গবেষণা বা সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীর অপ্রতুল সংখ্যা প্রত্যক্ষ করছি। যে বিষয়টি আগেই বলেছি যে, তরুন প্রজন্ম অনেক বেশি অস্থির ও উৎকন্ঠিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমি যদি বাংলাদেশের উদাহরণ দেই, তাহলে দেখা যাবে এই পরিবর্তন শুরু হয়েছে একুশ শতকের শুরু থেকে। আমরা যখন এন্ড্রয়েট জগতে প্রবেশ করি, তখন থেকেই এর ব্যবহারকারী এবং এটা যারা ব্যবহার করছেন না তাদের মধ্যে বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে অনেকেই আছেন যারা শুধুমাত্র প্রয়োজনে এটি ব্যবহার করেন, অপ্রয়োজনে নয়। নেট দুনিয়ায় তরুন প্রজন্ম তাদের জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করছে অপ্রয়োজনে। সময় ও নদীর স্রোত কখনো ফিরে আসে না, কিন্তু নেট দুনিয়ায় আসক্ত যারা তারা এসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। এটা তাদের পরর্বতী জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ছোট একটা গল্প বলি। আফ্রিকার কালাহারি অঞ্চলে বুশম্যানরা বাস করতো। সেখানে তাদের খুব ছোট একটি গ্রাম ছিল। তারা অধুনিক পৃথিবী সর্ম্পকে তেমন কিছুই জানতো না। তাদের পোশাকও ছিল প্রকৃতি থেকে তৈরি করা। তবে তারা পাড়া-প্রতিবেশি মিলেমিশে অনেক সুখে শান্তিতে বসবাস করতো। তাদের মধ্যে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিল না। তারা প্রকৃতি থেকে খাবার সংগ্রহ করতো। একদিন বুশম্যানদের একজন শিকারে গেল। সে হঠাৎ দেখলো যে আকাশে অনেক বড় একটি পাখি (বিমান) উড়ে যাচ্ছে। সে ভয়ে গাছের নিচে পালালো। হঠাৎ পাখি (বিমান) থেকে একটি কাঁচের বোতল তার সামনে এসে পড়লো। সে কাঁচের বোতলটিকে ইশ্বরের দেয়া উপহার মনে করে সাথে নিয়ে গেল। বোতলটি দেখে সবাই কৌতুহলী হয়ে উঠলো। কেউ বোতলটির মুখে ফুঁ দিয়ে শব্দ করছে। কেউ আবার বোতলটি দিয়ে তাদের খাদ্য ভাঙ্গা ও গুড়ো করার কাজে ব্যবহার করছে। বাচ্চারা বোতলটি নিয়ে খেলা করছে। আবার কেউ পশুর চামড়া সমান করার জন্য ব্যবহার করছে। এভাবে বোতলটির বহুবিধ ব্যবহার চলছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একই সময়ে বোতলটির প্রয়োজন হলে তাদের মধ্যে মনমালিন্য শুরু হলো। বাচ্চারা খেলার সময় এটি নিজের কাছে রাখার জন্য ঝগড়া করে। এভাবে খেলা সময় একদিন একটি শিশু আরেকটি শিশুকে বোতলটি দিয়ে আঘাত করে, ফলে তার মাথা ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। এটি নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা দেখে যে বুশম্যান বোতলটি কুড়িয়ে এনেছিল, সে ভাবে এটি কোন অভিশপ্ত বস্তু। এই বস্তু তার গ্রামে আসার পরে তাদের শান্তি নষ্ট হয়েছে। সে তখন বোতলটি নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলে, হে ইশ্বর এই বস্তুটি আমাদের প্রয়োজন নেই, এটি আকাশ থেকে এসেছে তাই আমি এটি আকাশের দিকেই ফিরিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু সেই আকাশে ছোঁড়া বোতলটি আবার তার কাছেই ফিরে আসে।
সে তখনো ভাবলো, এটি অসলেই কোন অভিশপ্ত বস্তু যেটা ইশ্বরও ফিরিয়ে নিতে চাইছে না। সবাই তখন বললো তাহলে এটি মাটিতে পুঁতে রাখো। সে তাই করলো। রাতের বেলা হায়েনা বোতলটি মাটির নিচ থেকে তুলে ফেললো, কারন বোতলটিতে শিশুর মাথার রক্ত লেগেছিল। সকালবেলা এক শিশু সেই বোতলটিতে ফুঁ দিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে গ্রামে প্রবেশ করলো। সবাই অবাক হয়ে ভাবলো, এই অভিশপ্ত বস্তুটি থেকে আমরা কিভাবে মুক্তি পাবো? গ্রামের সবাই মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো, এই অভিশপ্ত বস্তুটিকে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ফেলে দিয়ে আসবে। যে বুশম্যান অভিশপ্ত বস্তুটি গ্রামে নিয়ে এসেছিল, তার উপরই দায়িত্ব পড়লো বস্তুটিকে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ফেলে আসার। দায়িত্ব পেয়ে সেই বুশম্যান রওনা দিল এই অভিশপ্ত বস্তুটিকে তাদের সমাজ থেকে অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলে আসতে।
আমি তথ্যপ্রযুক্তির এই বস্তু গুলোকে কোনো ভাবেই অভিশপ্ত বা অশুভ বলছিনা। তবে অনেক ক্ষেত্রে এর অশুভ ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা আমরা সবাই জানি। তরুন প্রজন্মের বিশাল একটা অংশ এই প্রযুক্তির শুভ ব্যবহার করছে না। বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির বিকৃত ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভলো কিছু যে হচ্ছেনা তা নয়, তবে তা কতটুকু হচ্ছে তা আমাদের সবারই কমবেশি জানা। তথ্যপ্রযুক্তির অশুভ ব্যবহারের ফলে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে প্রতিনিয়ত। গল্পের সেই বুশম্যান যেমন তার গ্রাম থেকে সেই অভিশপ্ত ও অশুভ বস্তুটি তার গ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছিল, ঠিক তেমনি আমাদেরও উচিত এই বিশ্বগ্রাম থেকে তথপ্রযুক্তির অশুভ ব্যবহার পরিহার করে একটি মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ গড়ে তোলা।
মোঃ রফিকুল ইসলাম
সহকারী শিক্ষক (ভূগোল)
খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, ঢাকা।