প্রযুক্তিগত বিপ্লবের যুগেও উৎপাদনশীলতা কেন বাড়ছে না?

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » প্রযুক্তিগত বিপ্লবের যুগেও উৎপাদনশীলতা কেন বাড়ছে না?
মঙ্গলবার ● ২৫ জুলাই ২০২৩


ফাইল ছবি

বঙ্গ-নিউজ ডেস্কঃ  আমরা প্রায়ই বলি, আমরা ‘প্রযুক্তিগত বিপ্লবের’ যুগে বাস করছি। এখানে ব্যবসা আর কর্মক্ষেত্র বদলে গেছে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, দ্রুত যোগাযোগ, ডেটা প্রসেসিং, রোবোটিকস ও সর্বশেষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ছোঁয়ায়।

প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এত উন্নতির পরও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর প্রভাব চোখে পড়ছে না। এসব প্রযুক্তি যদি সত্যিই আমাদের জীবনে ও কর্মক্ষেত্রে গতি এনে থাকে, তবে উৎপাদনেও তার প্রভাব থাকার কথা। কিন্তু সেটা নেই কেন?

উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি কমছে
১৯৭৪ ও ২০০৮ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে কর্মীর মাথাপিছু বার্ষিক উৎপাদনশীলতার হার ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু ২০০৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার কমে প্রায় ০ দশমিক ৫ শতাংশে এ নেমে এসেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে যুক্তরাজ্যে উৎপাদনশীলতা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ০ দশমিক ৬ শতাংশ কম ছিল।

বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলোর চিত্র প্রায় এক। ১৯৯৫ ও ২০০৫ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু ২০০৫ থেকে ২০১৯ মেয়াদে এটি ১ দশমিক ৪ শতাংশে এ নেমে এসেছে।

আমরা উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বড় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একই সময়ে উৎপাদনশীলতার গতি স্থবির হতে হতে এখন হামাগুড়ি দিচ্ছে। আপাত এই প্যারাডক্সকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

হতে পারে, আমরা সবাই কাজ এড়াতে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। অবিরাম হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুদের মেসেজ করা, ইউটিউবে ভিডিও দেখা, টুইটারে অযথা তর্ক করা, বা বিনা কারণে ইন্টারনেট সার্ফ করা। অথবা বড় অন্তর্নিহিত কোনো কারণও থাকতে পারে।

উৎপাদনশীলতা নিয়ে যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা
উৎপাদনশীলতার বিষয়টিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন অর্থনীতিবিদরা। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট এবং চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাবসহ বেশ কিছু জটিল বিষয় এখানে ভূমিকা রাখে। প্রযুক্তির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে না পারার পেছনে দুটি প্রধান কারণকে দায়ী করেন তাঁরা।

প্রথমটি হলো- আমরা প্রযুক্তির প্রভাব সঠিকভাবে পরিমাপ করছি না। দ্বিতীয়টি হলো- অর্থনৈতিক বিপ্লব ধীর গতিতে হয়ে থাকে। সে জন্য প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সম্পূর্ণ সুবিধা পেতে কয়েক দশক লাগতে পারে।

ডেম ডায়ান কোয়েল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির বেনেট প্রফেসর উৎপাদনশীলতা পরিমাপ বিষয়ে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেছেন, ‘এমন কিছু নেই যা এখন ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে না, তবে কী ঘটছে তা এখনই দেখা কঠিন। কারণ এর কিছুই পরিসংখ্যানে দৃশ্যমান নয়। আমদের ডেটা সংগ্রহের পদ্ধতিই এর পেছনে রয়েছে।’

ডেম ডায়ান কোয়েল যুক্তি দেন, ‘আমরা প্রযুক্তির প্রভাব সঠিকভাবে পরিমাপ করছি না। উদাহরণস্বরূপ, একটি কোম্পানি আগে নিজস্ব কম্পিউটার সার্ভার এবং আইটি বিভাগে বিনিয়োগ করত। তাঁরা এখন বিদেশি ক্লাউড-ভিত্তিক আউটসোর্স করতে পারে। কোম্পাটি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কম টাকায় সেরা সফটওয়্যার পাচ্ছে, যা নির্ভরযোগ্য ও সর্বদা হালনাগাদ থাকছে।

আমরা যেভাবে অর্থনীতির স্বরূপ পরিমাপ করি তা একটি কোম্পানিকে বড় নয় বরং ছোট দেখায়। এটি আইটি অবকাঠামোর বিনিয়োগ দেখায় না, যা আগে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অংশ হিসাবে পরিমাপ করা হতো।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির বেনেট প্রফেসর ডেম ডায়ান কোয়েল। ছবি: সংগৃহীত
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির বেনেট প্রফেসর ডেম ডায়ান কোয়েল। ছবি: সংগৃহীত
শিল্প বিপ্লবের সময় কেন ছিল উৎপাদনশীলতা
বিষয়টি পরিষ্কার করতে ডেম কোয়েলের ১৯ শতকের শিল্প বিপ্লবের উদাহরণ দিয়েছেন। যেখানে পরিসংখ্যান থেকে কীভাবে উৎপাদনশীলতা বাদ পড়ে যায় তা চিত্রিত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যুক্তরাজ্যের ১৮৮৫ সালের পরিসংখ্যানের একটি তথ্য আছে। দীর্ঘ এই পরিসংখ্যানের ১২০ পৃষ্ঠায় কৃষি, ১২টি পৃষ্ঠায় খনি, রেলওয়ে এবং কটন মিলের তথ্য রয়েছে।’

শিল্প বিপ্লবের শিখরে সংগৃহীত এসব তথ্যের ৯০ শতাংশই ছিল অর্থনীতির পুরোনো ও কম গুরুত্বপূর্ণ খাত সম্পর্কে। আর মাত্র ১০ শতাংশ ছিল শিল্প সম্পর্কে। যা এখন বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ডেম কোয়েল বলেন, ‘আমরা অর্থনীতিকে এখনো অতীতের চোখেই দেখছি, আজকে কেমন তা নয়।’ এ প্রসঙ্গে তিনি ‘নিউ টেক ইকোনমি’র বিষয়টি তোলেন। এটি একটি সিরিজ যা নতুন প্রযুক্তি কীভাবে উদীয়মান অর্থনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দিচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করে।

অন্য যুক্তি হলো, বর্তমান প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটছে, কিন্তু সেটি আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ধীরে।

বাষ্প ইঞ্জিন ও বিদ্যুত আবিস্কারকালের অর্থনৈতিক বাস্তবতা
ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স বিজনেস স্কুলের অর্থনৈতিক ইতিহাসের ইমেরিটাস অধ্যাপক নিক ক্রাফটস। তিনি উল্লেখ করেছেন যে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিবর্তন রাতারাতি ঘটেছে বলে আমাদের অনেকেই মনে করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কয়েক দশক সময় লেগেছে এবং বর্তমানের প্রযুক্তিও একইভাবে সময় নিয়েই পরিবর্তন আনতে পারে।

তিনি বলেন, জেমস ওয়াটের বাষ্প ইঞ্জিন ১৭৬৯ সালে পেটেন্ট করা হয়েছিল। আর লিভারপুল থেকে ম্যানচেস্টার পর্যন্ত প্রথম বাণিজ্যিক রেলপথটি চালু হয়েছিল ১৮৩০ সালে। আর রেলওয়ে নেটওয়ার্কের মূলটি ১৮৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়েছিল। ফলে দেখা যায়, আবিষ্কারটি প্রায় ৮০ বছর নিয়েছিল অর্থনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করতে।

বিদ্যুতের ব্যবহারেও একই প্যাটার্ন দেখতে পাবেন। ১৮৭৯ সালে এডিসনের প্রথম সর্বজনীন লাইট বাল্ব ব্যবহার থেকে শুরু করে। আর সমগ্র দেশের বিদ্যুতায়ন এবং উৎপাদনে বাষ্প শক্তি প্রতিস্থাপনে সময় লেগেছিল কমপক্ষে ৪০ বছর। প্রকৃতপক্ষে আমরাও এখন একই রকম অবস্থার মধ্যে আছি বলা যায়।

প্রযুক্তির ব্যবহার ও উৎপাদনশীলতার ভবিষ্যৎ
তবে যেসব দেশ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নতুন প্রযুক্তির সর্বোত্তম এবং দ্রুততম ব্যবহার করতে পারে তারা উৎপাদনশীলতার দৌড়ে জয়ী হতে চলেছে। এটি বাষ্প এবং বিদ্যুতের সঙ্গে যেমন ছিল প্রযুক্তির বেলাতেও তাই হবে। আপনি এটিকে কতটা ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারেন, মানিয়ে নিতে পারেন এবং কাজে লাগাতে পারেন সেটিই কাজে দেবে।

ডেম কোয়েলের মতে, যে ধরনের কোম্পানিই হোক না কেন, যারা প্রযুক্তিটি ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে এবং যারা পারে না তাদের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান ভিন্নতা দেখা দেবে ভবিষ্যতে। এর অনেক প্রমাণও রয়েছে।

‘এটা মনে হচ্ছে যে, আপনার যদি উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন লোক থাকে, প্রচুর ডেটা থাকে এবং কর্মীরা অত্যাধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করতে জানে এবং তথ্য সহজে ব্যবহার জন্য কোম্পানির পরিচালনার প্রক্রিয়াগুলো পরিবর্তন করতে পারেন তাহলে আপনার উৎপাদনশীলতা সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে।’

কারণ অর্থনীতির একই খাতে এমন অন্যান্য কোম্পানি রয়েছে যারা এটি করতে পারবে না। প্রযুক্তি আপাতদৃষ্টিতে সমস্যা নয় এবং কিছু ক্ষেত্রে এটি সমাধানও নয়। উচ্চ উৎপাদনশীলতা শুধু তাদের দ্বারেই আসবে যারা এটির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২:৫৫:১৮ ● ২২১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ