রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন;৩১৫ তম পর্ব-জালাল উদ্দীন মাহমুদ
Home Page »
সাহিত্য »
রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন;৩১৫ তম পর্ব-জালাল উদ্দীন মাহমুদ
হাজেরা আপার জল চিকিৎসা -১৩
সত্যি বলছি ,আমি কিছুতেই চাইনি কাজেম উদ্দিন স্যারের জন্য পাতা ফাঁদে হাজেরা আপা জড়িয়ে পডুক। রফিক সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চিকিৎসা প্রদানের জন্য সে ডিটারমাইন্ড। মিন্নাত তো মজা দেখার জন্য এক পায়ে খাড়া । হাবিব ২ জগ পানি আর ১টা গ্লাস নিয়ে দন্ডায়মান। রফিক সাহেব লাল লাল মোটা মোটা দুটি মোমবাতি বের করে টেবিলে রেখেছে। হরতাল চলায় ব্যাংক একদম ফাঁকা । হাজেরা আপা স্বয়ং চিকিৎসা নেয়ার জন্য উন্মুখ। তারে ঠেকাবে কে আর আমিই বা বাঁধা দেয়ার কে ? বাঁধা দিলেও বোধহয় কেউ শুনবেও না। বরং বাঁধা দিলে বাঁধবে লড়াই।
সে সময় দেশে মাঝে-মধ্যেই হরতাল ডাকা হতো। সেদিন মনে হয় আধাবেলা হরতাল ছিল। হরতাল শেষ হতে চলেছে।ব্যাংকের লেনদেন শুরুর সময় ঘনিয়ে আসছে । যা করার এখনি করতে হবে। রফিক সাহেব চিকিৎসা শুরু করল। আমি আবারো বাঁধা দেবার চেস্টা করলাম , লাভ হলো না । সংখ্যাগরিষ্টের মত লংঘনের মতো মনোবলও হয়তো আমার তখন ছিল না। তা থাকলে তো সপ্তপদী মার্কেটে সেদিন এতো বড় নির্মম ঘটনা সংঘটিত হতো না।
রফিক সাহেব প্রথমে আপার বাম কনুইয়ে মোমবাতি দ্বারা ৩বার আঘাত করল। আপা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। তৃতীয় বার আঘাতের সময় শক্ত মোটা মোমবাতিটাই ভেঙ্গে গেল। আমি আঘাতের শব্দের তীব্রতা বুঝে কাল্পনিক একটা রিডিং লিখলাম।
রফিক সাহেব এরপর আর একটা মোমবাতি নিয়ে ডান কনুইয়ে আঘাত শুরু করল। আমি আবার কাল্পনিক একটা রিডিং লিখলাম। এবার অবশ্য মোমবাতিটা ভাঙ্গল না। তবে প্রতিটা আঘাতের সময় আপার আর্তচিৎকার শুনতে পাওয়া গেল। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে রিডিং লিখছিলাম, তাই তার বেদনাহত মুখের অবস্থা তেমনভাবে আমার নজরে আসেনি। তবে যে মিন্নাত প্রত্যহ এত হাসত এখন দেখি সেও গম্ভীর মুখে চুপচাপ বসে আছে।
এভাবে আঘাত করাকে কেউ ভালোভাবে নিচ্ছে না। হাবিব তো এক সময় বলেই বসল, আর মারার দরকার নেই স্যার। রফিক সাহেব বললো, না কপালেও আঘাত করে তার রিডিং নিতে হবে। সবচেয়ে ভয়ানক আঘাত শুরু হলো। ভাঙ্গাটা সহ রফিক সাহেব দু‘টো মোমবাতি একত্র করে আঘাত করলেন। আমি কম্পিত হস্তে আবার কাল্পনিক রিডিং লিখলাম।
এবার আমি হাজেরা আপার দিকে তাকালাম। বেচারা নিজের হাত দিয়েই একবার এ কনুই আর একবার অন্য কনুই তারপর একবার কপালে হাত বুলাচ্ছেন। মুখ দিয়ে বাংলা স্বরবর্ণের যতগুলো বর্ণ আছে সবগুলোই উচ্চারন করছে। তবে সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করছেন ”উ” আর ”আ” বর্ণ দুটি। আমার খুব খারাপ লাগলো। জেদী আপা নিজেই নিজের বিপদ ডেকে এনেছে। আমাদেরও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। রফিক সাহেব আমাকে আঘাতের মোট কত রিডিং এসেছে জিজ্ঞেস করলেন। কত রিডিং বলেছিলাম তাতো আজ আর মনে নেই। মনে করি ১.৩।
রফিক সাহেব রিডিং শুনে বললেন পুরা একজগ এবং তিন গ্লাস পানি এখনই খেতে হবে। আমি বাঁধা দেবার চেস্টা করলাম , লাভ হলো না। হাবিব রেডি ছিল। আপার সামনে গ্লাস ভর্তি পানি রাখল। রফিক সাহেব বলল-খান আপা। আপা বিনা বাক্য ব্যায়ে তিন গ্লাস পানি পান করল। আপা তারপর আর পানি খেতে চাচ্ছিল না। রফিক সাহেবের চাপাচাপিতে আরো এক / দুই গ্লাস খেলো। জগ থেকে ঢেলে ঢেলে পানি দেয়া হলো। আপা সেদিন মোট কত গ্লাস পানি খেয়েছিল তা আজ আর সঠিক মনে নেই। তবে আকন্ঠ পানি পানের পর এক সময় মুখে হাত দিয়ে করিডোর পেরিয়ে দ্রুত জোনাল অফিসের দিকে রওনা দিয়েছিল আপা ।
দুষ্ট কাজেম উদ্দিন স্যারকে শায়েস্তা করার জন্য লিখিত চিত্রনাট্যটি যে নিরপরাধ কিন্তু স্বেচ্ছায় জোরপূর্বক ফাঁদে পা দেয়া হাজেরা আপাকে নিয়ে মঞ্চস্থ হয়ে গেল কোন প্রকার হৈচৈ না হওয়ায় তা অফিসের অন্য কেউই টের পেল না। অন্য দিকে আধবেলা হরতাল শেষ হয়ে যাওয়াই আমরা ব্যাংকের কাজ-কর্মে মন দিলাম। তবে আমি সেদিন কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছিলাম না। পরিকল্পনায় কি ছিল আর বাস্তবে কি ঘটলো।কি চাইলাম আর হলো কি । নজরুল কি আর সাধে বলেছিলেন “আমি প্রিয়ার চিঠি চাইতে এলো কিনা ইনকামট্যাক্স-এর খাম।”
আমিই বা কেন সায় দিলাম। আবার সায় না দিয়ে উপায়ই বা কি ছিল? হাজেরা আপার সাথে তাছাড়া চিরদিনের মনোমালিন্য সৃষ্টি হতো। রফিক-মিন্নাতও চাচ্ছিল। আমি একা বাঁধা দিব কেমনে।দৈনন্দিন লেন-দেনের কাজে সেদিন আর শান্তি পাচ্ছিলাম না। মনে হলো পাশের জোনাল অফিসে গিয়ে আপাকে একবার দেখে তার হাল-হকিকত জিজ্ঞাসা করে আসি। উঠি উঠি করছি কিন্তু আমাকে আর উঠতে হলো না। দেখি হাজিরা আপা অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে কুঁকড়িয়ে কুঁকড়িয়ে আমার দিকে হেঁটে আসছে। তার হাঁটার ধরন দেখে আমার বুকের ভিতর ধড়াক করে উঠলো। মনে হলো আঘাত গুরুতর হয়েছে।
( চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ২১:০০:৩২ ●
৩৮৬ বার পঠিত
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)