হাজেরা আপার জল চিকিৎসা -১০
হাবিব জানাল তার বউয়ের রাতে ভালো ঘুম হচ্ছিল না। সেটা এই স্যারকে(রফিক সাহেব)বলি। স্যার আমাকে বলে যে আমার নিকট থেকে নাকি ২ ঘন্টা ঘুম কেটে নিয়ে স্যার আমার স্ত্রীকে দিতে পারবে। আমি রাজি হই। স্যার আমাদের নাম ও পিতার নাম একটা কাগজে লিখে নেয়। আমার স্ত্রীর মত আছে কিনা তা জানতে চায় । স্ত্রী মত দেয়। সেই থেকে আমার স্ত্রীর ভালো ঘুম হচ্ছে কিন্তু আমার আর ভালো ঘুম হচ্ছে না। বলা বাহুল্য, রফিক সাহেব এসব কথা আগেই হাবিবকে শিখিয়ে দিয়েছিল। হাবিব যে এত নিখুঁত অভিনয় করে বলতে পারবে সে বিশ্বাস অবশ্য আমাদের ছিল না। হাবিবের এ সাক্ষীর পর রফিক সাহেবের চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যাপারে কাজেমউদ্দিন স্যারের আর সন্দেহ থাকার কথা না। কিন্তু আমরা তখনও টের পাইনি এ স্যার কতটা ধুর্ত। আমরা ঘুরছি ডালে ডালে আর স্যার পাতায় পাতায় নয় একেবারে পাতার ডগায় ডগায়।
ঠিক আছে জালাল, তুমি বলেছিলে রফিক পৃথিবীর ৩টি গুরুত্বপূর্ন আবিষ্কার করেছে। প্রথমটি বুঝলাম জল চিকিৎসা। দ্বিতীয়টি ঘুম এ্যাডজাস্ট করা। তিন নম্বরটা কি, তা বল এখন। স্যার আমাকে তাগাদা দিলেন। আমি বললাম, স্যার আমি এখন ওটাই বলতে চাচ্ছিলাম। এটার নাম মনের কথা খুলে না বলার পরিনাম অনেকেই আজকাল গ্যাস্ট্রিক, আলসার দীর্ঘময়োদী আমাশয় , পেট কামড়ি , পেট ফোলা , পেটে গ্যাস , কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি পেটের সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে ইরিটাবল বাওয়েল সিন্ড্রোম বা আইবিএস । তালোড়ার বিখ্যাত কবিরাজ রফিক আহম্মেদ চৌধুরীই প্রথম আবিষ্কার করেন যে, কেউ যদি মনের কথা কাউকে খুলে না বলে দীর্ঘ দিন মনের মাঝে আটকে রাখে তবে ঐ সব কথা পচে-গলে যায় এবং এ কারনেই গ্যাস্ট্রিক বা আলসার বা এ ধরনের পেটের পীড়া রোগের উৎপত্তি হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,একটা মন আর একটা মনকে খুঁজিতেছে নিজের ভাবনার ভার নামাইয়া দিবার জন্য, নিজের মনের ভাবকে অন্যের মনে ভাবিত করিবার জন্য। কিন্তু এ ব্যস্ত দুনিয়ায় এমন আর একটা মন সে কোথায় পাবে ? রফিক সাহেব এক্ষেত্রে হেল্প করেন। উনি বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে মনের কথা বের করে এনে এ রোগ থেকে শত শত মানুষকে মুক্ত করেছেন।
-কীভাবে ?স্যার জানতে চাইলেন ।
-সে অনেক কথা ।
-হোক অনেক কথা ,তুমি বলো ।
-উনি প্রথমে মুখের পাড়ার মুখ ছাড়া সব রাস্তা একটা মোটা গামছা দিয়ে বেঁধে বন্ধ করে দেন।
-মুখের পাড়ার রাস্তা ?
-স্যারের মুখের পাড়ায় ৪ টি রাস্তা আছে । চোখ , নাক ,কান আর মুখ । উনি মুখ ছাড়া সব রাস্তা বন্ধ করে দেন। যাতে দ্রুত বের হওয়া উর্ধমুখী মনের কথাগুলি মুখ ছাড়া অন্য কোনও দিক দিয়ে বের হয়ে সে অঙ্গের ক্ষতি না করতে পারে।
-দ্রুত বের হওয়া উর্ধমুখী মনের কথা মানে ?
- এতা সব বোঝার দরকার আছে স্যার?
-আছে ?
-তাহলে শুনুন । মানুষের মনের এমন অনেক কথা আছে যা মানুষ বাধ্য না হলে অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে চায় না।রফিক সাহেব এ বাধ্য হবার কাজটি করে।
-কীভাবে ?
-সব শোনার দরকার নাই স্যার।
আমি সবকিছু বলতে চাচ্ছিলাম না। কারন এ চিকিৎসার ব্যাপারে কী বলব সে বিষয়ে আমাদের তেমন পূর্ব প্রস্তুতি ছিলনা।
-সবই শুনতে চাই । তাড়াতাড়ি বলো ।
-তাহলে শুনুন । আমি একটু সময় নিয়ে কী বলব তার একটা ছক ঠিক করে নিলাম। তারপর বললাম-
প্রথমেই বলে রাখি শুধু বসন্তকালে এ রোগের চিকিৎসা হয়।
-তুমি শুধু চিকিৎসার পদ্ধতিটি বলো।
- বলছি । একটা নির্জন রুমে রোগীকে নিয়ে রফিক সাহেব প্রথমে একটা মোটা গামছা দিয়ে বেঁধে চোখ , নাক আর কান বন্ধ করে দেন। তারপর মুখের ভিতর নেশা জাগানো একপ্রকার গাছের ডালের খুব ছোট ছোট কিছু টুকরা রাখেন। তারপর মহুয়া ফুলের রস খাওয়ান। চোখের সামনে পলাশ ও শিমুল ফুল রাখেন । গামছা চোখ থেকে সরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষনের জন্র ফুল দেখার সুযোগ করে দেন। পলাশ ও শিমুল মনের ঘুম ভাঙ্গানোর কাজ করে। রোগী এক সময় সম্মোহিত হয়ে পড়ে -ও পলাশ ও শিমুল কেন এ মন মোর রাঙালে জানিনা জানিনা আমার এ ঘুম কেন ভাঙালে গানটি গাইতে থাকে । রোগী না গাইলে রফিক সাহেব নিজেই এ গান গায় । এ সময় রফিক সাহেব রোগীকে মনের কথা খুলে বলতে চিৎকার করে তাগাদা দেন । তার চিৎকারে রোগীর কথা গুলো মন থেকে মস্তিস্কে এস ভিড় করে। সে সময় রফিক সাহেব মাথার ভারী একটা বই বা অন্য কিছু রাখেন। ভারী পদার্থের চাপে কথাগুলি মুখে আসা শুরু করে। কিন্তু রোগী কিছুতেই গোপন কথা মুখ থেকে বের করতে চায় না। । সেসময় রফিক সাহেব রোগীর মুখের ভিতর ছোট একটা চুম্বক রেখে মুখের বাইরে আর একটা চুম্বক ধরে থাকে। এক সময় অটোমেটিক দ্রুত বেগে কথা বের হতে থাকে। তবে প্রথমে বের হয় মুখের ভিতরে রাখা চুম্বক চুম্বক কী বেগে বের হয় তা দেখে রফিক সাহেব বুঝতে পারে রোগীর মনের ভিতর কতো কথা জমে আছে।
আমি বানিয়ে বানিয়ে গোঁজামিল দিয়ে ক্যানভাসারের ঢং-এ কথাগুলি বলছিলাম। আমার এতো কথা বলতে রাজী হবার কারণ স্যার যেন বিশ্বাস করে রফিক সাহেব একজন বড়ো মাপের চিকিৎসক।
কিন্তু আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথে স্যার উঠে দাড়াঁলেন। বললেন-তোমাদের এসব আজগুবি কথা শোনার জন্যই কি আমাকে আজ ডেকেছ? যাই আমি।
আমরা হতচকিত হয়ে পড়লাম। আমাদের প্ল্যান বুঝি ভেস্তে যায়। আমরা তো পণ করেছি স্যারকে আজ জল চিকিৎসা দিবই। জগ ভর্তি পানি নিয়ে হাবিবকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির মতো করে রেডি রাখা হয়েছে। হাসির ব্রেকফেল ওস্তাদ মিন্নাতের দিকে চেয়ে দেখলাম-শিকার ফসকে যাচ্ছে দেখে সেও হতচকিত।
বরাবরের মতো রফিক সাহেবই ত্রানকর্তার ভূমিকায় অবর্তীন হতে চাইলেন। শোনা গেল আবার তার দরাজ গলা,স্যার প্লীজ আর একটু বসুন। আমি তো চিকিৎসা করা ছেড়েই দিয়েছি। আপনার উপকার করার জন্যই তা আবার আজকে শুরু করতে যাচ্ছি। আমি দেখি সব সময় আপনার মুখ কেমন শুকনা শুকনা লাগে। আজও লাগছে। সামান্য জল চিকিৎসাতেই তা সেরে যাবে। ব্যাটা হাবিব এদিকে পানির জগ আর গ্লাস লে আও। হাবিব দৌঁড়ে এসে পানির জগ রফিক সাহেবের টেবিলে এনে রাখল। কয়েক গ্লাস পানি খেলেই আপনি স্যার ঠিক হয়ে যাবেন। স্যার আমাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। টাকা ধার নেয়। বোঝাই যাচ্ছে তিনি কোন ভাবেই আমাদের সাথে সম্পর্কের তিক্ততা সৃষ্টি করতে চান না। তাই হয়তো পানি খেতে রাজি হলেন। বললেন, দাও দেখি পানি খাই। কয় গ্লাস খাবো? রফিক সাহেব সাথে সাথে বলে বসলো- এখানেই স্যার প্রশ্ন। আপনার ঠিক কত গ্লাস জল খেতে হবে সে ডোজটা ঠিকমতো নির্ণয় করতে হবে। স্যার বললো-নির্ণয় করো।
- এজন্য একটা টেস্ট লাগবে।
-টেস্ট? কিসের টেস্ট?-
-সাউন্ড টেস্ট।
-সাউন্ড টেস্ট?এর আগেও বলেছিলে । কিন্তু সেটা কি?
বলছি স্যার। রফিক সাহেব আবার হাবিবকে ডাকলেন। ইয়া হাবিব, ইয়া হাবিব, দো মোমবাতি ইধার লে আও। হাবিব লাল রংয়ের ইয়া মোটা মোটা ২টা মোমবাতি রফিক সাহেবের টেবিলে এনে রাখল। রফিক সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জালাল সাহেব আপনি তো টেস্টের টেকনিশিয়ান। আপনিই স্যারকে বুঝিয়ে বলেন।
দেখলাম এবার সবকিছু পরিকল্পনা মোতাবেকই অগ্রসর হচ্ছে। আমি এখন সাউন্ড টেস্টটা ঠিকমতো বোঝাতে পারলেই হয়। প্রথমে মোমবাতি দ্বারা জোরে জোরে আঘাত করে তাকে অসুস্থ করে কন্ঠ পর্যন্ত পানি পান করিয়ে তার দু‘নম্বরী কাজের আজ উচিৎ জবাব দিতে হবে। আমাদের মধ্যে টান টান উত্তেজনা। মিন্নাত এতো উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে টেবিলের উপর দু‘হাত রেখে , দু‘হাতের উপর আবার মাথা রেখে নেতিয়ে পড়ল। আমি “সাউন্ড টেস্ট” বিষয়টির ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করলাম।
( চলবে )