
- হাজেরা আপার জল চিকিৎসা-৩
কাজেম উদ্দিন স্যারকে নিয়ে ভয়ংকর কাহিনির এ অধ্যায়টির আপাতত নাম দিতে চাই “অপূর্ব জল চিকিৎসা”। কাহিনিটির কীভাবে সূত্রপাত হয়েছিল তা এখন শুরু করছি।
একদিন রফিক সাহেব বললো, কাজেমউদ্দিন স্যারের প্রতি মাসের টাকা ধারের এসব ব্যবস্থা আর ভালো লাগে না। স্যার অনেকের সাথেই দু নম্বরী করছে। তা করে করুক। কিন্তু আপনার সাথে করবে এটা আমি মেনে নিব না। স্যারকে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে।
- কিন্তু ক্যামনে?
- হবেই একটা ব্যবস্থা।
- কি ব্যবস্থা?
- ঘটনাক্রমে তাকে অপমান করতে হবে।
- কি ঘটনা?
- একটা কিছু উপায় বের করতে হবে ।
প্রত্যহ অফিস শেষ হলে আমরা অফিসের বাহিরে দাড়াঁতাম। আর ভাবতাম কীভাবে স্যারকে জব্দ করা যায়। মিন্নাত আলীও সাথে থাকত। কিন্তু উপায় খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আবার শলা-পরামর্শ করার মতো পর্যাপ্ত সময় এবং উপযুক্ত স্থানও পাচ্ছিলাম না।একবার ভাবলাম ম্যানেজার স্যারকে কথাটা জানাব। কিন্তু উনি তো বলবেন তোমরাই ম্যানেজ করো।
কী যেন কী কারনে দেশে কয়েকদিন হরতাল ছিল।
এসব হরতালের সময় ব্যাংকে তেমন কাস্টমার আসত না। গেটও বন্ধ থাকত। আমরা পেন্ডিং কিছু কাজ করতাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমরা এ সময় কাজেমউদ্দিন স্যারকে জব্দ করার কৌশল ঠিক করলাম। সিনেমায় যেমন নায়ক বা পার্শ্বনায়কের সাথে একজন করে কৌতুকাভিনেতা থাকে , আমাদের সাথে তেমনিভাবে থাকলো মিন্নাত। আর মহিলা কোটায় উপস্থিত থাকল জাহাঁনুর (ইনচার্জ ,মহিলা কর্নার)। এরা দু জনই আবার রফিক সাহেবের ব্যাচমেট। সম্ভবত ১৯৭৮ সালের দিকে ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক হিসেবে ব্যাংকে যোগদান করেছিল তারা। সে সময় ব্যাংক-শাখায় তাদের ব্যাচের কর্মকর্তাদের আধিপত্য ছিল প্রশ্নাতীত।
যা হোক ,কয়েকটি বৈঠকের পর আমরা কাজেমউদ্দিন স্যারকে জব্দ করার একটা কার্য পদ্ধতি ঠিক করলাম। কাজটা মোটামুটি একটা নাটকের মতো হবে। চিত্রনাট্য রেডি করলাম আমি। প্রধান চরিত্রে থাকবে একজন কবিরাজ । কবিরাজের ভূমিকায় থাকবেন রফিক সাহেব। সাক্ষী হবে পিওন হাবিব। রোগী কাজেমউদ্দিন স্যার। নাটকের নাম - জল চিকিৎসা। আমাদের সব পরিকল্পনা শুনে জাঁহানুর ভীত হয়ে আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করল। ভয় সংক্রামক । তাই আমিও ভীত হয়ে এ নাটক না করার জন্য রফিক সাহেবকে বারবার অনুরোধ করলাম। রফিক সাহেব বললো- জেল হোক, ফাঁসি হোক তার হবে। তবুও সে কাজেমউদ্দিন স্যারকে জব্দ না করে ছাড়বে না। সে কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা থাকার সময় সব সময় প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে আমি যেন তাকে সহযোগিতা করি। সে কত কত বাঁকা লোককে সোজা পথে এনেছে , কাজেম উদ্দিন স্যার তো সে তুলনায় কিছুই না। অন্যায় কজের প্রতিবাদ করলে যা থাকে কপালে তাই হবে। সাহসও সংক্রামিত হল। ঠিক হলো সামনে যেদিন কাজেমউদ্দিন স্যার আবার চেক বন্ধক রেখে টাকা নিতে আসবে সেদিনই আমরা আমাদের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজেমউদ্দিন স্যারকে জব্দ করব। ক্যাশিয়ারকে রফিক সাহেব বলে দিল, কাজেমউদ্দিন স্যার অগ্রীম ডেটের চেক দিয়ে টাকা নিতে আসলে , সে যেন না দেয়, আমাদেরকে জানায়।
রফিক সাহেবের দৃঢ়তা এবং আমার প্রাথমিক সম্মতি সত্ত্বেও কাজেম উদ্দিন স্যারকে জব্দ করতে মন সায় দিচ্ছিল না। মনে হলো এ মাস টাকা দিয়ে কাজেম উদ্দিন স্যার কে ভালো করে বুঝিয়ে বলব । তারপরেও উনি যদি এসব করেন তবে তখন ম্যানেজার স্যারের নিকট নালিশ দিব।দেখব তখন উনি কি বলেন।উনি ব্যবস্থা না নিলে তখন দেখা যাবে। রফিক সাহেব এ প্রস্তাবে রাজি হলো।
পরের মাসে ম্যানেজার স্যারের নিকট নালিশ দিতে হলো । আমার নালিশ শুনে উনি অনেকক্ষন ধরে হাসলেন । তারপর বললেন আগে আমার সাথে কাজেম উদ্দিন স্যার এ সব করত । এখন তোমার সাথে শুরু করেছে।আমি ক্ষতি স্বীকার করে পার পেয়েছি।
- ক্ষতি স্বীকার করে পার পেয়েছেন মানে ?
প্রথমে ২০০ টাকা ধার দিয়ে শুরু করেছি। পরের মাসে বললেন আর ৩০০ টাকা দিয়ে ৫০০ টাকা মিল করে দেন । আমি একসাথে ৫০০ টাকার নোট দিয়ে ধার শোধ দিব । পরের মাসে ৫০০ টাকা তো শোধ দিলেনই না, আরো ৫০০ টাকা ধার দিয়ে ১০০০ টাকা মিল করে দিতে বললেন। আমি আর তাকে টাকা দেইনি । শুনেছিলাম একজনের কাছে ২০০ টাকা দিয়ে ধার শুরু করে উনি পর্যায় ক্রমে তার কাছ থেকে ৫০০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন । সে ব্যাক্তিই টাকার দাবি ছেড়ে দিয়ে তার কাছ থেকে পালিয়ে বেঁচেছে । নইলে হয়তো এক সময় তার বাড়ি-ঘর বেঁচে ধার বাড়াতে হতো।
এ টুকু বলে ম্যানেজার অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন।
তার হাসি আমার ভালো লাগছিল না। আমি জানতে চাইলাম ক্ষতি স্বীকার করে পার পেয়েছেন এ কথার মানে কী ?
-মানে আবার কী ? আমি বললাম আমি আর আপনাকে টাকা ধার দিতে পারব না। আপনাকেও আর ঐ ৫০০ টাকা ফেরৎ দিতে হবে না। কী আর করব বলো বয়সে সিনিয়র মানুষ বেশী কিছু বলাও যায় না।
-কিন্তু আমি এখন কী করব ?
- তুমি নরম মানুষ । কিছু করতে পারবে না। কাজেম উদ্দিন স্যার কিন্তু মানুষ ভালো না। আমি কিছু বললে আমার কাছেই আবার ধার চেয়ে বসবে। তুমি বরং রফিককে বলে দেখ। সে কিছু করতে পারে কি- না।
কাজেম স্যারের ইমেজ আমার চোখে ঝাপসা হয়ে গেল। অসহায় ম্যানেজারের কাছ থেকে উঠে আসলাম ।
অতিরিক্ত উত্তেজিত হতে পারে তাই রফিক সাহেবকে ম্যানেজারের নিকট থেকে তার টাকা ধার নেবার বিষয়টি বললাম না।
একদিন মধ্যাহ্ন বিরতির সময় রফিক সাহেব একজন কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে আমার টেবিলের সামনে এসে বসল। সে কর্মকর্তার নাম আজ আর মনে করতে পারছি না।
এ কর্মকর্তা নাকি এক ছুটির দিনে ব্যাগ হাতে বাজারে যাচ্ছিল। রাস্তায় কাজেম উদ্দিন স্যারের সাথে দেখা। স্যার এ কর্মকর্তাকে তার মটরসাইকেলে তুলে নেয় ও পেট্রল পাম্পে যেয়ে ৫০ টাকার পেট্রল নেয়। তার পর একটা ছেঁড়া নোট বের করে দেয় পাম্পের ক্যাশ কাউন্টারে। কাউন্টার ছেঁড়া নোট নিবে না। তখন এ কর্মকর্তার কাছ থেকে তিনি ৫০ টাকা নিয়ে পেট্রলের পাম্পে দেন।কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল শুধু ঘুরাচ্ছেন । এখন বলে বোনাস পেলে দিব। আসলে উনি দিবেন না। । এ রকম ঘটনা নাকি আরো আছে।
অফিসারটি বলল একজনের কাছ থেকে ব্যাখা তলবের জবাব লিখে দিয়েও ৫০ টাকা নিয়েছেন।
রফিক সাহেব পকেট থেকে ১০টি টাকা বের করলেন। তারপর আমার , মিন্নাতের ও জাঁহানুরের কাছ থেকে ১০ টাকা করে নিয়ে এ অফিসারের পকেটে ৪০ টাকা জোর করে দিয়ে দিলেন। বললেন আমরা তোমাকে সাহায্য করলাম।
কাজেম স্যারের ইমেজ আমার চোখে কলঙ্কের কালিমায় ঢাকা পড়ে গেল।
একদিন রফিক সাহেব আমাকে বলল গত কালের ঘটনা কিছু জানি কিনা ।
-কি ঘটনা ?
-কর্মচারী সংসদের আমিনুল ও রেজাউল কাজেম উদ্দিন স্যারকে মারার জন্য তাড়া করেছিল।
কেন?
-কেন আবার? এক কর্মচারীর কাছ থেকে টাকা চেয়েছিল।
-তাহলে তাড়া খেয়ে এবার হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
-ঠিক হবে না জালাল সাহেব।
-দেখা যাক।
কয়েকদিন পর মিন্নাত জানালো কাজেম স্যার নাকি তার কাছে টাকা ধার চেয়েছে। মিন্নাত স্যারের স্বভাব জানে তাই ধার দেয়নি।
রফিক সাহেব মিন্নাতের এ ঘটনা শুনে সাফ সাফ বলে দিল ডিম পাড়বে হাঁসে, আর খাবে বাঘডাশে তা সে মেনে নিবে না।
ব্যাংকের লোক এ রকম হয় না। কাজেম স্যার তো মান –সম্মান আর রাখবে না দেখি। আমি বুঝতে পারলাম , কাজেম স্যারের ব্যাচমেটরা প্রায় সবাই এ জি এম হলেও তার প্রমোশন কেন হয়নি ।তিনি কেন জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্য জেলায় বদলি হয়েছেন-তাও বুঝতে পারলাম।
আমার চোখে স্যারের ইমেজ ধুলায় মিশিয়ে গেল।
নিরীহ মিন্নাতকে টার্গেট করায় রফিক সাহেব আহত বাঘের মতো আক্রমণমুখী হয়ে উঠতে চাইল। রফিক সাহেব এবার যখন তাকে অপদস্থ করার কথা বলল তখন আমি বাধা দিতে পারলাম না।
রফিক সাহেব আমাকে ও মিন্নাতকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে লাগল।
হরতালের কোনও একদিন। পরিকল্পনা মোতাবেক ক্যাশিয়ারের নিকট সেদিন প্রত্যাখ্যত হয়ে কাজেমউদ্দিন স্যার আমার টেবিলের সামনে বসল। বলল- জালাল তোমরা নাকি ক্যাশিয়ারকে টাকা দিতে নিষেধ করেছ। আর ১০/১৫ দিন পর বেতন হলেই তুমি তো টাকা তুলে নিতে পারবা।
-টাকা তো তুলে নিতে পারব ঠিক আছে। কিন্তু ১০/১২ দিনের জন্য আমাকে তো ৫০০ টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক মাসে অনেক কষ্ট করে আমাকে টাকা ম্যানেজ করতে হয়।
-আমার জন্য না হয় একটু কষ্ট করলে।
এমন সময় পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক রফিক সাহেব আমার দিকে লক্ষ্যে করে বলে উঠলো, দেখেন দেখেন জালাল সাহেব স্যারকে কিছু হেল্প করা যায় কিনা?
ঠিক আছে আমি দেখছি। একথা বলে স্যারের জন্য চায়ের কথা বললাম। আজ আমাদের অন্য প্ল্যান আছে। রফিক সাহেব বলেছে স্যারকে যেভাবেই হোক জব্দ করতে হবে। কারন উনি শুধু আমাদেরকে নয় আরো অনেককে নানাভাবে জ্বালাতন করছেন। টাকা ধার নিচ্ছেন। বাখ্যা তলব করাচ্ছেন। ব্যাখ্যা তলবের জবাব লিখে টাকা নিচ্ছেন। আর তার মোটর সাইকেলের তেল নানাভাবে ম্যানেজ করছেন। তাই আমরা তাকে জব্দ করার বৈধতা খুঁজে পেয়েছি। জব্দ করার জবরদস্ত কৌশলও উদ্ভাবন করেছি। জল চিকিৎসার নামে তাকে জব্দ করা হবে। কীভাবে স্যারকে রফিক সাহেব জব্দ করে তা দেখার আশায় মিন্নাত অধীর অপেক্ষায়।
( চলবে)