১৯৭১,মুক্তিযুদ্ধের কথা-৭
ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। জল,স্থল ও অন্তরীক্ষে সমান তালে এগিয়ে চলছে এ যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রচন্ডতা এতো বেশি যে, প্রতি মুহূর্তে শব্দে-গর্জনে কাঁপছে সারা দেশ। লালমনিরহাট অঞ্চল থেকে তিনটি বাহিনীর আক্রমণ দেখা যায়নি। শুধু স্থল এবং আকাশ পথের যুদ্ধই আমরা দেখেছি। জলসীমা এখানে না থাকায় নৌ সেনারা শুধু সাগর ও নদী বন্দর এলাকাতে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। মুক্তি বাহিনীর সদস্যগণ মূলত গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেছে বলে বাংলাদেশ সীমান্তে আনাগোনা করতে হয়েছে। প্রায় সময়ই আক্রমণ করে আবার ভারতে চলে যেতে হয়েছে। তবে তারা ছিল অকূতভয় বীর। বুকে পর্বত প্রমাণ সাহস ও কষ্ট সহিষ্ণুতা তাদেরকে করেছে অপ্রতিদ্বন্দী। মানুষ কি ভাবে মুক্তিযুদ্ধাদের একটু সাহায্য করবে সেই মনোভাবই তারা ব্যক্ত করেছে। তবে মুক্তিযোদ্ধারাও সচেতনতা অবলম্বন করেছে অনেক ক্ষেত্রে। কারণ সাহায্যের আড়ালে অনেকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। যদিও এই ধরনের কাজ খুব অল্প সংখ্যক লোকই করছে। ধরা পড়লে পাক বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনেও মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেরা মুখ খোলেনি। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধ্যান বলে দেয়নি। সেসব অত্যাচারের কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌ সেক্টরের অধীনে সফলতম একটি নৌ গেরিলা অপারেশন ছিল ”অপারেশন জ্যাকপট”। এটি ছিল একটি আত্মঘাতী অপারেশন। এ অপারেশন ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট রাত ১২টার পর অর্থাৎ ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম মোংলা সমুদ্র বন্দরে এবং দেশের অভ্যন্তরের চাঁদপুর ও নারায়নগঞ্জ নদী বন্দরে একই সময়ে পরিচালিত হয়। ১০নং সেক্টরের অধীনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত নৌ কমান্ডো যোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার নিদর্শন এই অপারেশন জ্যাকপট। এই গেরিলা অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক গুলো অস্ত্র ও রসদবাহী জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ গুলোর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্যকারী অনেক বিদেশী জাহাজ থাকায় এই অপারেশন বাংলাদেশের যুদ্ধ এবং যোদ্ধাদেরকে সারা বিশ্বে পরিচিতি পাইয়ে দেয়। এতে পাকিস্তানিদের মনোবল আরও ভেঙ্গে যায়।
আকাশে ভুবন কাঁপানো শব্দে ঝাঁকে ঝাঁকে জঙ্গী বিমান উড়েছে। তাদেরকে প্রতিহত করতে না পেরে পাক সেনারা ক্রমাগত ভাবে পিছু হটে যেতে থাকে। গ্রাম থেকে থানা, থানা থেকে মহকুমা আর মহকুমা থেকে জেলা সদরে তারা অবস্থান নিতে থাকে। যাবার সময় প্রচুর ধ্বংসাত্মক কাজ ,লুটতরাজ, মানুষ খুন ও অগ্নি সংযোগ করতে থাকে। আমাদের সংবাদ জানার জন্য তখন একমাত্র উপায় ছিল বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ। ভারতের আকাশবাণী কোলকাতা, আকাশবাণী দিল্লী, আসামের গৌহাটি ইত্যাদি কেন্দ্র। আর বাংলদেশের নিজস্ব বেতার কেন্দ্র ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি প্রথমে চট্টগ্রামের কালুর ঘাটে স্থাপিত ছিল। স্বল্পমাত্রার প্রেরণ কেন্দ্র হওয়ায় সংবাদ বা বুলেটিন খুব বেশি দুরে যেতো না। তাও আবার কয়েকদিন যেতে না যেতেই পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। পরে সেটিকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। উক্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বুলেটিন, সংবাদ ও রম্যরচনা আমাদের সকলের আকর্ষণের কেন্দবিন্দু ছিল। অনুষ্ঠানটি যতক্ষণ সম্প্রচার করা হতো ততোক্ষণ শ্রোতাদের ভীড় লেগেই থাকতো। তার মধ্যে সকল শ্রোতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দিত ও উৎসাহিত করতো প্রখ্যাত সাংবাদিক এম আর আক্তার মুকুলের “ চরম” পত্র নামক অনুষ্ঠানটি। জনাব মুকুল নিজেই রচনা করতেন এবং নিজেই পাঠ করতেন। ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনায় ও রচনায় সকলকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি পাকিস্তানের সৈন্য ও নাগরিকদের মনোবল মারাত্মক ভাবে দুর্বল করে দিতো। আরও প্রচারিত হতো নাটক, কথিকা, আর দেশাত্মবোধক গান। বেতারে অংশ গ্রহনকারীদের শব্দ সৈনিক বলা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের সাথে থাকতো ছোট ছোট ট্রানজিস্টার। যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান শুনে নিতো।
শরনার্থী শিবিরে প্রতিদিন দেখেছি মৃত্যুর মিছিল। এতো মৃত্যু জীবনে আগে দেখিনি। বিশেষ করে বৃদ্ধ এবং শিশুদের মৃত্যু। অপুস্টি ও অযত্নে এবং পানিবাহিত নানান রোগে আক্রান্ত হতো বেশি শিশু ও বৃদ্ধরা। শরণার্থী শিবিরে চিকিৎসার ব্যবস্থাও ছিল । কিন্তু তথাপী মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যেতো না। ডায়োরিয়া এবং পরে শেষের দিকে চর্মরোগ, চক্ষু উঠা ইত্যাদি রোগে মৃত্যু লেগেই থাকতো প্রতিদিন। বিভিন্ন দেশ সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও অনেক শিবির পরিদর্শন করেছেন। তবে তিনি আমাদের শিবিরে আসেননি। বহু বিদেশি মেডিক্যাল টীম এসেছিল চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে। আমরা যে ক্যাম্পে ছিলাম, সে ক্যাম্পে অবশ্য তুলনামূলক মৃত্যু একটু কম ছিল। কিন্তু অন্য সব ক্যাম্পে মৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি। তাদের যথাযথ অন্তেষ্টি ক্রিয়াও করা সম্ভব হতো না। শুনেছি মেঘালয়ের ঢালু এবং তুরা ক্যাম্পে মৃত্যুর চিত্র ছিল খুবই ভয়ংকর। একে একে লাশ নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছে, কোন রকমে সামান্য আগুন দিয়েছে অথবা অর্ধপোঁতা করে রেখে এসেছে। পরিবারের সদস্যগণ কান্নাও ভুলে গিয়েছিল। চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। এই সব অকাল মৃত্যু তো ঘটেছিল দেশের স্বাধীনতা লাভের আশায়, দেশের স্বাধীনতার জন্য। তবুও ওরা কোনদিনই শহীদের তালিকায় আসবে না। হয়তো বা ইতিহাসে তাহাদের নাম লিখা রবে না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, দেশের মধ্যে থাকা শতভাগ হিন্দুকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। আর হিন্দুদের উপর আক্রমণ করা ছিল পাকবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য। রাজাকারেরা এই সন্ধানটাই পাক বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতে সচেষ্ট ছিল বেশি। আরও প্রমাণিত হয় , শরণার্থীদের সংখ্যা পর্যালোচনা করলে। সমগ্র ভারতে প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। তন্মধ্যে ৯০% শরণার্থী ছিল হিন্দু,বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের। মানুষের এতো ত্যাগ স্বীকার ভাবতেও অবাক লাগে।
যুদ্ধে পাকিস্তানিরা একবারেই মনোবল হারিয়ে ফেলছিল। সাধারণ প্রতিরোধ টুকুও তারা করতে সক্ষম ছিল না। ভারতের সাথে ইতিপূর্বে পাকিস্তান কোন যুদ্ধেই জয়লাভ করতে পারেনি। এই তথ্যটি ভারতের বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সিদ্দিক শালিকের লেখা বই ”উইটনেস টু সারেন্ডার” পুস্তকে লিখা আছে। বইটির বাংলা অনুবাদ” নিয়াজির আত্ম সমর্পণের দলিল”। সিদ্দিক শালিক মেজর পদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তদানীন্তন পুর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত লে,জে,সাহবজাদা ইয়াকুব খানের জনসংযোগ অফিসার ছিলেন। তিনি জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। তাই এবারের যুদ্ধেও পাকিস্তানিরা ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়লো। তাছাড়া ভারতের রণ কৌশল ছিল ভিন্ন। একটি উদাহরণ দিলে বুঝা যাবে। ঢাকার চতুর্দিকে ভারতীয় সৈন্য ঘিরে রয়েছে বলে প্রচার চালানো হয়। ভারতীয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশ বার বার ঘোষণা দিতে ছিল পাকবাহিনীর উদ্দেশ্যে- আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে আপনাদের প্রতি আচরণ করা হবে। আপনাদের চারদিক থেকে ভারতীয় সৈন্য ঘিরে ফেলেছে, ইত্যাদি। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন লে.জে, জগজিৎ সিং অরোরা। ঢাকার পাশে মিরপুর ব্রিজের কাছ থেকে কমান্ডার জ্যাকব ঘোষণা দিতে ছিলেন এবং নিয়াজির সাথে কথা বলতে ছিলেন। তিনি জানালেন - আপনার চারদিকে হাজার হাজার সৈন্য ঘিরে রেখেছে। আত্ম সমর্পণ করুন, নিজে বাঁচুন এবং আপনার লোকদেরকে রক্ষা করুন। এসব প্রচারনায় নিয়াজী আত্মসমর্পনে রাজি হয়ে ছিলেন। যদিও আমেরিকার সপ্তম নৌবহর আসার জন্য ক্ষীণ আশা জ্বালিয়ে রেখে ছিল নিয়াজীর মনে। সোভিয়েত রাশিয়ার অষ্টম নৌবহর পাঠানোর সংবাদে আমেরিকা পিছিয়ে যায় সপ্তম নৌবহর আর পাঠায়নি। ফলে নিয়াজী আত্ম সমর্পনে রাজি হয় । ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের বিকাল ৪.৩১মি. সময়ে নিয়াজির আত্ম সমর্পনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। উল্লেখ্য যে, জ্যাকব-ফারজ-রাফায়েল বা জেএফআর জ্যাকবের অধীনে তখন খুব সামান্য সৈন্য ছিল। সেটাকে কয়েকগুণ বেশি করে বলা হয়েছিল।
(চলবে)