সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৭৩:স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৭৩:স্বপন চক্রবর্তী
রবিবার ● ২ জুলাই ২০২৩


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

১৯৭১,মুক্তিযুদ্ধের অস্থির সময়গুলো-৫

পরে পত্রালাপ হয়েছে মার সঙ্গে। বড় ভাইয়ের ( সুশান্ত) সঙ্গে। জেনে ছিলাম বৃদ্ধ মা-বাবা ফুলদা ( সুশান্তদা ) এবং সবার ছোট ভাই সুজন কি করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে ময়মনসিহ শহর হতে মেঘালয় রাজ্যে গিয়েছিল। সম্মানিত পাঠক, আমার ভান্ডারের সামান্য ভাষা জ্ঞান উজার করে লিখলেও সেই কাহিনীর যথার্থ বর্ণনা হবে না। অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বৃদ্ধ মা-বাবা অন্য দুই ভাইকে নিয়ে কয়েকদিনে গিয়ে পৌঁছান মেঘালয়ে। মেঘালয়ের বহু ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে ঠাঁই পান ঢালু শিবিরে। রাস্তায় খাওয়া-নাওয়া ছিল না। সাথে থাকা সামান্য খাবার পথিমধ্যেই শেষ হয়ে যায়। শুধু কলের জল ছিল অবলম্বণ। এখানে লেখার ইচ্ছে না থাকলেও প্রসঙ্গটি এসে যাওয়ায় আমার মেজদা ঊষারঞ্জন চক্রবর্তীর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন অবস্থার একটু সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে চাই।

ঊষারঞ্জন চক্রবর্তী (গত ০৭/১২/২৩ প্রয়াত হয়েছেন)

মেজদা তখনো একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করে ময়মনসিংহ শহরে। মালিকের অনুরোধে সে চাকুরি করতেই থাকেিএই যুদ্ধকালীন বৈরী পরিবেশেও। সে ময়মনসিংহ শহরেই থেকে যায়। একদিন রাজাকারেরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। ময়মনসিংহ শহরের পাদদেশে ব্রহ্মপুত্র নদী প্রবাহিত। সেই নদীর বালুচরে তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। উদ্দেশ্যটিও তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। দেশের পরম শত্রুদের নিধন করার নাকি নির্দেশ রয়েছে। সেই নির্দেশ বলেই হোক, বা অতি উৎসাহী হয়েই হোক, ব্রহ্মপুত্রের বালুচরে বহু লোককে ধরে এনে রাজাকারগন এই গুরুদায়িত্ব পালন করেছে। এবার মেজদার পালা। তাকেও বালুচরে নিয়ে আসা হলো। বালুচরে এনে একেবারে অন্তিম সময়ে অর্থাৎ গুলি করার পূর্ব মুহূর্তে ভুঁইয়া কোম্পানীর মালিক মতি ভুঁইয়া সাহেব গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হন নদীর পারে। তিনি তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। মতি ভূঁইয়া সাহেব তখন নূরুল আমিনের পিডিপি ( পাকিস্তান ডেমক্রেটিক পার্টি ) এর ময়মনসিংহ জেলার একজন পদস্থ কর্মকর্তা। পাকিস্তানপন্থী এই দলের একজন উর্দ্ধতন ব্যক্তি হওয়ায় মেজদাকে মুক্ত হতে আর কোন অসুবিধা হয়নি। ভূঁইয়া সাহেব নিজে গাড়ি চালিয়ে মেজদাকে ব্রহ্মপুত্রের ওপারে শম্ভূগঞ্জে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে বললেন ,ঊষা তুমি চলে যাও, নইলে তোমাকে বোধ হয় আর বাঁচাতে পারবো না।
নদী পরে হয়ে হাঁটতে শুরু করে মেজদা। আজ এখানে কাল ওখানে করে সে পৌঁছে কিশোরগঞ্জে। মাঝে বহু চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে গেলো। সেসব বর্ণনা খুবই বিপদ সংকুল ও ভীতিপূর্ণ । কিশোরগঞ্জ শহরের অদুরে বিন্নাটি গ্রামে গিয়ে একটি পরিবারের দুরাবস্থা দেখে সমবেদনা জানাতে গিয়েই হোক অথবা ভালো লাগার কারণেই হোক, সেই পরিবারের দ্বিতীয় মেয়ে বিজয়া দেবীকে বিবাহ করে মেজদা। পরিবারের প্রথম মেয়ের ইতিপূর্বেই বিবাহ হয়েছে। পরিবারটির সাতজন মেয়ে এবং তিনজন ছেলে। তবে অন্য সবাই বলতে গেলে নাবালক। রাজাকারেরা বাড়িটিতে অগ্নি সংযোগ করায় পরিবারের সদস্যগণ পালিয়ে পালিয়ে আবার কখনো বা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে দিনাতীপাত করছিল। যাহোক, রিক্ত অবস্থায় মেঝদার মাথায় তখন বোঝার উপর শাকের আঁটি । তখন সে কোন নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করে অন্তহীন পথের সন্ধানে চললো। পরে আশ্রয় নিয়ে ছিল ফুলপুর থানাধীন এক আত্মীয় বাড়িতে। সেই বাড়ির কর্তা ব্যক্তির বদান্যতায় পিছনে লেগে যায় লুটেরা। লুটেরাদের উদ্দেশ্য লুন্ঠণ করা। চেনা পরিচিত ব্যক্তিরা প্রস্তাব দেয় এই যাত্রায় তাকে সাহায্যের করার। লাগেজ নিয়ে পৌঁছে দিবে সীমান্ত পর্যন্ত। সাহায্যের প্রস্তাবে এবং কিছুটা কষ্ট লাগবের প্রত্যাশায় তাদের কাছের লাগেজ গুলো দেওয়া হয় কথিত সহায়তাকারীদের হাতে।। ছোট ছোট একটি দুটি বাক্স-পেটারা মাথায় করে পিছু পিছু যেতে যেতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায় সেই সাহায্যকারী। বাক্সে ছিল বিবাহের সামান্য অলংকার ও কিছু সামান্য টাকা-পয়সা। শেষ সম্বল হারিয়ে নব বিবাহিতা স্ত্রীকে বোরখা পরিয়ে এবং নিজের মাথা নেড়ে করে শুধু হাঁটছে আর হাঁটছে। রাস্তায় ক্ষুধা নিবৃত্ত করেছে টিউবওয়েলের পানি দিয়ে। এই ভাবে দু’একদিন পর গিয়ে সীমান্তের ওপারে মেঘালয় রজ্যে পৌঁছে। রাস্থায় যেখানেই আশ্রয় নিতে চেয়েছে সেখান থেকেই অসহযোগীতা ও শংকার কারণে চলে যেতে হয়েছে অন্যত্র।
মেঘালয়ের শরনার্থী শিবিরগুলোতে পৌঁছে একটার পর একটা শরনার্থী শিবির খোঁজে বেড়াচ্ছে। উদ্দেশ্য কোথাও পরিবারের সদস্যদের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। সে বড় কঠিন অনুসন্ধান। সাথে নবপরিণীতা অভুক্ত অনাহারি ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন আর একটি মুখ। কোথাও কোন খাবার ব্যবস্থা হয়নি। পরিবারের কোন সদস্যের সাক্ষাৎও মেলেনি। শেষে নিরাশ হয়ে শরনার্থী শিবিরের অদুরে একটি গাছের নিচে উভয়ে বসে বাকহীন ও উদ্দেশ্যহীন অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছে। এমন সময় অদুরে দেখতে পেলো মাকে। একটি টিউবওয়েলের নিচে মা কিছু থালাবাসন ধৌত করছেন। চেহারা চিনতেও কষ্ট হচ্ছিল। চেনা যায় না। খাবার হয়তো মিলতেছিল, কিন্তু দেশ ও পরিবারের সকলের চিন্তায় উদ্ভ্রান্তের মতো প্রায় অবস্থা। পিছনে গিয়ে মাকে ডাক দিতেই মা পলকহীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেষে “ উষারঞ্জন”!! বলে খুব জোরে চিৎকার দিযে উচ্চ শব্দে কান্না করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। এক সাগর শঙ্কা ও মনোকষ্ট মনে হয় এক সাথে বের হয়ে এলো চোখের জলের সাথে। মেজদা শুধু বলতেছিল “ কাঁদছেন কেন? আমিতো এসে গেছি।”কিন্তু কান্না আর থামতেছিল না। পুঞ্জিভুত শোকের সুপ্ত ভিসুভিয়াসটি যেন বিরাট বিষ্ফোরণে উদ্গিরিত হতে থাকলো। (চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ২০:৩৮:১৯ ● ৬৮৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ