সাজেদা আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি, বঙ্গনিউজ:
‘এইটা খোদার অদেখা জায়গা’ দূর্গম হাওর জনপদ মধ্যনগর নিয়ে এই খেদোক্তি করেছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মরহুম অধ্যাপক শাহেদ আলী। ‘জিবরাইলের ডানা’খ্যাত এই সাহিত্যিকের জন্মস্থান পার্শ্ববর্তী মধ্যনগরের অদূরে তাহিরপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে। তৎকালীন সময়ে তাহিরপুরের ওই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিকতার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই মধ্যনগর।
জানা যায়, প্রায় দেড়শো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই মধ্যনগর বাজার একসময়ে ময়মনসিংহের গৌরিপুর স্টেটস এর আওতাধীন ও বংশীকুন্ডা পরগণার অন্তর্ভূক্ত ছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর মধ্যনগর বর্তমান থানা কমপ্লেক্সে স্থাপিত হয় Anti Dacoit Police Camp (ADPC) । জনগণের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা লাঘব ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের নিমিত্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭৪ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় চারটি ইউনিয়ন (মধ্যনগর, চামরদানী, বংশীকুণ্ডা দক্ষিণ, বংশীকুণ্ডা উত্তর) নিয়ে মধ্যনগর থানা গঠিত হয়।
মধ্যনগর থানাটি এত দিন ধর্মপাশা উপজেলার অধীন ছিল। ধর্মপাশা উপজেলা সদর থেকে উত্তরে ভারত সীমান্তবর্তী বংশীকুন্ডা উত্তর ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
এ কারণে প্রশাসনিক, শিক্ষা, চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন সেবা নিতে এ থানার মানুষ দীর্ঘ বছর ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ অবস্থার উত্তরণে ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত (নিকার) ৮৬তম বৈঠকে মধ্যনগর থানা এলাকার উপর্যুক্ত চারটি ইউনিয়ন নিয়ে মধ্যনগর উপজেলা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে ৮৮তম সভায় সিদ্ধান্তটি বাতিল করে দেয়।
গত ২০২১ সালের ২৬ জুলাই প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস–সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার) ১১৭তম সভায় মধ্যনগর থানাটিকে উপজেলা হিসেবে উন্নীত করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নিকার অধিশাখা থেকে গত বছরের ১০ আগস্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ–সংক্রান্ত ও ২৪ অক্টোবর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে নবগঠিত মধ্যনগর উপজেলা গঠনের তফসিল–সংক্রান্ত (সীমানা নির্ধারণ) গেজেট প্রকাশিত হয়।
গত বছরের(২০২২ খ্রীস্টাব্দ) ২৪ জুলাই নবগঠিত এই উপজেলায় প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। এই উপজেলার আয়তন ২২১ বর্গকিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা রয়েছে ৯২ হাজার ৭৪৫ জন। এখানে ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় ১টি, ২০ একরের ঊর্ধ্বে জলমহাল ৩২টি, ২০ একরের নিচে জলমহালের সংখ্যা ১২টি, হাটবাজারের সংখ্যা ৪টি, শিক্ষার হার ২৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৪টি। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১০টি ও ১টি কলেজ রয়েছে। এ ছাড়া মোট কৃষিজমির পরিমাণ ১৫ হাজার ৬০০ হেক্টর।
নবসৃষ্ট হাওড় উপজেলা মধ্যনগরে প্রশাসনিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরুর এক বছর পেরোলেও উপজেলা কেন্দ্রীক সেবা ও সুবিধা এখনো মধ্যনগরবাসীর ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়,এ উপজেলার ২৩টি দপ্তরের ২১২ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীর বিপরীতে কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৯জন কর্মচারীর দুইজনের স্থায়ী নিয়োগ থাকলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগের জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শুধুই কাগজে কলমে।
বিভিন্ন উপজেলায় কর্মরত কর্মকর্তাগনকে এ উপজেলায় অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। ইউএনও সহ বেশিরভাগ কর্মকর্তার স্থায়ী কর্মস্থল ধর্মপাশা উপজেলা হওয়ায় দাপ্তরিক কাজকর্মে এ উপজেলাবাসীকে এখনো যেতে হয় ধর্মপাশা উপজেলায়।
মধ্যনগরে এখনো উপজেলার প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হয়নি।স্থাপন করা হয়নি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তাই চিকিৎসার জন্য এ উপজেলাবাসী সবচেয়ে নিকটবর্তী হাসপাতাল নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সএর উপর নির্ভরশীল। মধ্যনগর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলো হতে কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সএর দূরত্ব গড়ে ২২-২৫কিলোমিটার।
‘বর্ষায় নাও-হেমন্তে পাও’ এটি মধ্যনগরের যোগাযোগ ব্যবস্থার নিয়ে স্থানীয়দের মুখে প্রচলিত প্রবাদ।সারা উপজেলায় বিচ্ছিন্নভাবে মাত্র কয়েক পাকা ও সাবমার্জেবল সড়ক থাকলেও বষায় এসব সড়ক পানির নিচে চলে যায়। ফলে উপজেলার অভ্যন্তরে এখনো নিরবচ্ছিন্ন যান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। তাই বর্ষা মৌসুমে নৌকায় কয়েক ঘন্টার পথ পেড়িয়ে কলমাকান্দা হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া গেলেও শুকনা মৌসুমে বেশীরভাগ গ্রামের মানুষের একমাত্র ভরসা বাঁশ কাঠের চাঙ।এজন্য মধ্যনগর উপজেলার মানুষের কাছে চিকিৎসা সেবা যেন দুর্ভোগের আরেক নাম।
উপজেলায় দুইটি ইউনিয়ন পরিবার কল্যান কেন্দ্রের একটি পরিত্যক্ত ও অন্যটিতে নেই সেবাকার্যক্রম। রয়েছে দুইটি ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। কেন্দ্র দুটি হলো মধ্যনগর মা ও শিশু কল্যাণ এবং দাতিয়াপাড়া ফুলেন্নেছা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়,প্রতিটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে দুজন বিশেষজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার সহ ১৬জনের জনবল থাকার কথা। তার বিপরীতে দাতিয়াপাড়া কেন্দ্রে সরকারিভাবে উন্নয়ন খাতের আওতায় ১জন নাসিং এটেন্টেডেন্ট,১ জন আয়া,১জন অফিস সহায়ক দিয়ে চলছে বহির্বিভাগ ও জরুরি ডেলিভারি সেবাকার্যক্রম। মধ্যনগর কেন্দ্রে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা(এনজিও) কর্তৃক ২জন নার্সিং এটেন্টেট ও ১জন আয়া এবং ১জন নৈশ্য প্রহরী কর্মরত রয়েছেন।
এতেকরে যে উদ্দেশে এই মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে , তার সুফল পাওয়া যাচ্ছেনা। ফলে এ কেন্দ্র দুটি কার্যত চকচকে নয়নাভিরাম সুদৃশ্য ভবন মাত্র। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে মধ্যনগর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের একটি ভবন উপজেলা প্রশাসনের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মধ্যনগর উপজেলায় রয়েছে ১১টি কমিউনিটি ক্লিনিক। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকার সারাদেশে এই কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করে। প্রতিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে অন্তত ছয় হাজার মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাসহ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচি, পরামর্শসহ বিভিন্ন সেবা পাওয়ার কথা। কিন্তু দক্ষ জনবল ও নিয়মিত তদারকির অভাবে এর মূল উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না।তবুও উপজেলার মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র নির্ভরশীলতার স্থান এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো।
মধ্যনগর উপজেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে জানতে চাইলে, ধর্মপাশা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুসতানসির বিল্লাহ বলেন, মধ্যনগরে একটি ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের অনুমোদন হয়েছিল। সেখানে গত বছর পূর্বে একজন সরকারি এমবিবিএস ডাক্তারের পদায়ন করা হয়েছিল।
হাসপাতালের কোনো অবকাঠামো না থাকার কারণে বর্তমানে সেই এমবিবিএস ডাক্তার ধর্মপাশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন।