সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৭২: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৭২: স্বপন চক্রবর্তী
শুক্রবার ● ৩০ জুন ২০২৩


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

১৯৭১,মুক্তিযুদ্ধ-৪

শরনার্থী শিবিরে থাকি । বিশ টাকা দিয়ে একটি ঘর কিনে ছিলাম এক শরনার্থীর নিকট হতে। বাংলাদেশ হতে কয়েকজনে মিলে মাথায় করে ঘরটি সীমান্তের ওপারে নিয়ে এসেছিল। বেশ বড়সড় একটা খড়ের ঘর। আমি এবং আমার ছোট ভাই বিজন তখন থাকি এক সাথে। আমার মা বাবা ভাইবোন কে কোথায় তখন কিছুই জানি না। শুধু রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনি। একদিন শুনলাম যে, পাক বাহিনী শম্ভূগঞ্জে ব্যাপক বোমা ফেলেছে। ময়মনসিংহ শহর হতে প্রাণ ভয়ে লোকজন তখন ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে এই শম্ভূগঞ্জ দিয়েই সীমান্তের দিকে যাচ্ছিল। খবরটি শোনে অজানা এক আশংকায় মন খুবই ভারাক্রান্ত হলো। কারণ আমাদের পরিবার তখন ময়মনসিংহ শহরের বাসিন্দা। দুই ভাই কে কাকে সান্তনা দেব। বেশ কদিন কাটলো দুর্শ্চিন্তায়।
কি করলে মন মানসিকতা ঠিক থাকবে জানিনা। একদিন সাথে করে নেয়া চটের বস্তায় থাকা বই ও পুরাতন কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে একটি লিখিত পোস্টকার্ড পেলাম। খামটি বোধ হয় কোন কারণে পোস্ট করা হয়নি। আমার বড় দাদা চারু প্রসন্ন চক্রবর্তী (প্রায় চার বছর আগে প্রয়াত) আগরতলায় বসবাসকারী দিদিমাকে ( মায়ের মা ) লিখেছিল। আমি এই পোস্টকার্ডে লিখা ঠিকানাটা হয়তো সঠিক হবে মনে করে তা কাজে লাগিয়ে ছিলাম। চিটি লিখলাম দিদি মাকে। আমি আমার বিস্তারিত পরিচয় দিয়ে চিঠি লিখলাম। কারণ আমাকে কোন দিন দেখেনি,তাই পরিচয় দেওয়াটা সমীচীন মনে করলাম। বললাম,বর্তমানে আমরা দুইভাই নিম্ন ঠিকানায় আছি। মা বাবা ভাইবোন ও অন্যদের কারো কোন খোঁজ পাচ্ছিনা। যদি আপনার কাছে কোন সন্ধান থেকে থাকে তা হলে আমাকে নিচের ঠিকানায় জানাবেন। আমি কোচবিহার জেলার শীতলখুচি থানাধীন বড়মরিচা পোস্টমাস্টারের প্রযত্নে ঠিকানাটি দিয়েছিলাম। চতুর্দিকে অন্ধকারময় দিনগুলোতে তখন এই একটি মাত্র ভরসা নিয়ে অপেক্ষায় আছি। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর একটি চিঠি পেলাম দিদিমার কাছ থেকে। চিঠিখানি পুরো যেন একটা বিলাপে ভরপুর। যার সার মর্ম করলে এই দাঁড়ায় যে, “ তোমাদের মা-বাবা আত্মীয় স্বজনের কোন সন্ধান আমার কাছে নেই। আমার শেষ জীবনে এসে এমন দুঃসংবাদ আমাকে বহন করতে হবে তা ভাবিনি। তোমাদেরকে কি সন্ত্বনা দেব জানিনা। তোমরা ছোট। আমি একবারে অচল মানুষ। তোমাদেরকে গিয়ে দেখে আসবো এমন সামর্থ আমার নেই। যদি পার কোন রকমে আমার এখানে চলে এসো। পরে আমি সব দেখবো। টাকা পয়সা লাগলে তাও ব্যবস্থা করবো। “ যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই আমরাও খুব আতঙ্কিত অবস্থায় দিনাতিপাত করে চলেছি- ইত্যাদি ইত্যাদি।
পত্রটি হঠাৎ জ্বলে উঠা শেষ আশার আলো টুকুও নিভিয়ে দিল। মানুষ একটা আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। আমাদের তাও নেই। এইভাবে দিন চলছিল। অনিয়মিত হলেও তখন যা রেশন পাই তাই দিয়ে নিজ হাতে চাল-ডাল সিদ্ধ করি । জঠর জ্বালা নিবৃত্ত করি। বিতারিত মানুষের ঢল আসতেই থাকে ওপার হতে। তবে সবাই অচেনা-অজানা। কেমন যেন অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেদেরকে। দেশের অভ্যন্তর হতে বহু পথ হেঁটে ঝড়ো কাকের মতো অবস্থায় এসেছে অনেক পরিবার। কোলে শিশু হাতে পুটলি, মাথায় ঝাঁকা, কারো হাতে গরু ছাগলের রশি। সে সব দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। কালে ভদ্রে দু’একজন পরিচিত মানুষ থাকলেও কারো সাথে কালো তেমন আলাপচারিতা নেই। সবাই আপনারে লয়ে বিব্রত।
আরও সপ্তাহ খানেক পর আর একটি চিঠি পেলাম দিদিমার কাছ থেকে। তিনি লিখলেন, “ ভাই স্বপন, তোমাদের পিতামাতার কোন সন্ধান নেই মর্মে চিঠি লিখার অব্যবহিত পরই সুশান্তর (আমার অব্যবহিত বড় ) একটি পত্র পেলাম। সে লিখেছে তারা সবাই মেঘালয়ের ”ঢালু” শরনার্থী শিবিরে আছে। আমি তোমাদের ঠিকানা তাদেরকে দিয়েছি আর তাদের ঠিকানা তোমাকে দিলাম-এই বলে আবারও বিলাপে ভরপুর একটি পত্র। পুর্বেই উল্লেখ করেছি,জীবনে তিনি আমাকে দেখেননি। একবার অন্তত দেখতে ইচ্ছে তাঁর। আমিও কখনো দেখিনি। এখনতো দেখার আর প্রশ্নই আসে না। কারণ লিখাটি যখন লিখছি, তখন আর নেই, বহু আগেই গতায়ু হয়েছেন। হিন্দুরা যেহেতু পর জন্মে বিশ্বাস করে তাই ভরসা যে, সেখানে হয়তো দিদিমার দেখা পাব। আমাদেরকে তাঁর একটু দেখার জন্য যে বাসনা, তা হয়তো পূরণ হবে। তাও সন্দেহ থাকে ,সেখানে তিনি আমাদেরকে চিনবেন কি করে? আমার শরীরের কোন জন্মদাগের কথাও তো তাঁকে বলে দেইনি। পাসপোর্ট অফিসে এবং বীমা অফিসে এমন জন্ম দাগের উল্লেখ করতে হয়।
( চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ২০:৫৪:২৭ ● ৫৯০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ