১৯৭১,মুক্তিযুদ্ধ-৩
সূর্যের উত্তাপ সহ্য করা গেলেও বালির উত্তাপ খুবই অসহনীয়। রাজাকারদের অত্যাচারে মানুষ সব চেয়ে বেশি অতিষ্ঠ ছিল। পাক বাহিনী তখন ছিল হাতীবান্ধা সদরে। শুধু টহলে আসতো মাঝে মাঝে। কিন্তু রাজাকারদের আগমণ ঘটতো হরহামেশাই। তারা অত্যাচার ও লুন্ঠনে ছিল সিদ্ধহস্ত। মাঠের বা গোহালের গরু-ছাগল পর্যন্ত নিয়ে যেতো। ফলে মানুষ ছিল খুব অতিষ্ঠ। কে মুক্তিযুদ্ধা, কে হিন্দু, কে আওয়ামী লীগার বা কার বাড়ি থেকে কেউ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে ইত্যাদির খবরা খবর পাক সেনাদেরকে রাজাকাররা সরবরাহ করতো। সরবরাহ করতো কোন মুক্তিযোদ্ধা গোপনে মায়ের সাথে দেখা করতে আসে। যেন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব তাদের উপর। পরে পাকি মিলিটারী এসে ব্যবস্থা গ্রহণ করতো। নির্যাতন হতো ভয়ংকর ও বর্ণনাতীত। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিতো আগুন দিয়ে। সীমান্তের কাছে ওরা বেশি ভিড়তো না,কারণ ভারতীয় সেনাদের ভয়ে। তবে দইখাওয়াতে সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল শফিকুল ইসলাম নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে দইখাওয়াকে তখন ঘোষণা করা হয়েছিল ”শহীদ শফিক নগর” নামে। সেই নামটি কেন মুছে গেলো তা জানিনা। শুনেছি পরে যুদ্ধ শেষে এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশটি তার পরিবারের লোকেরা নিজ এলাকায় নিয়ে যায় ।
রাজাকার ও পাকি মিলিটারীদের অত্যাচার ও নিপীড়ন কি মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছিল তার কিছু বিবরণ জানা যাবে গবেষক, ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের লেখা “গণহত্যা, রাষ্ট্র ও জাদুঘর” নামক বইটিতে। সম্মানিত পাঠকদের জন্য বইটিতে থেকে বিশেষ বিশেষ কিছু অংশ নিচে তুলে ধরছি।
-১৯৭১ সালে বগুড়া ও ঠাকুরগাঁয় কর্মরত ছিলেন লে. কর্নেল আজিজ আহমেদ খান। হামুদুর রহমান কমিশনে তিনি বলেছেন, জেনারেল নিয়াজী তার ইউনিট পরিদর্শনকালে জিজ্ঞেস করেন, “কয়টি ন্দিু মেরেছ ?’ মে মাসে ২৩ ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ মালিক লিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন হিন্দু হত্যার। ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহমান হামাদুর রহমান কমিশনে বলেছিলেন জেনারেল গুল হাসান সৈন্যদের জিজ্ঞেস করতেন, “কয়জন বাঙালি মেরেছ ?” ৮ম বালুচের কমান্ডার লে. কর্ণেল আজিজ আহমেদ খান জানিয়েছেন, ব্রিগেডিয়ার আরবাব জয়দেবপুরে সব বাড়ি পুড়িয়ে দিতে বলেছিলেন। আমি তা করেছি।” ব্রিগেডিয়ার মালিকের নির্দেশে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে একরাতে ১৭ জন বাঙালি অফিসার ও ৯১৫ জন হত্যার অভিযোগ আনা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের হত্যার সময় বলা হতো – “বাংলাদেশ পাঠাও।” মেজর জেনারেল ফরমান আলী যাকে বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী করা হয় , তিনি বলেছিলেন-
Harrowing ( দুঃখজনক ) tales of rape, Loot, arson( অগ্নি সংযোগ ),harassment ( হয়রানি) and of insulting ( অপমান ) and degrading ( অপমান জনক ) narrated in general term.” জেনারেল নিয়াজি বলেছেন- ‘ you scratch ( আঁচড় ) any Bengali and he is separationist ( বিচ্ছিন্নতাবাদী )। .” শুধু তাই নয়,আরো লিখেছিলেন- There must be more killing, more mopping up and more with hunting.” (পৃষ্ঠা:২১-২২ )
তিনি আরও লিখেছেন- গণহত্যার একটি তাত্বিক কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন পাকিস্তানি কর্মকর্তারা। এ তত্ব নির্মাণ শুরু হয় ১৯৪৭ সালের পর। এই তত্বের মূল কথা ছিল –বাঙালি মুসলমানরা পুরোপুরি বা “খাস’ মুসলমান নয়, তারা আধা মুসলমান। ভারতীয় বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত। এ কারণে তারা কেন্দ্রের কর্তৃত্ব মানতে চায় না যারা খাঁটি মুসলমান। বাঙালিদের মাথা খারাপ করেছে হিন্দু শিক্ষকেরা। এবং হিন্দুরা বা ভারত পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে বাঙালিদের মাধ্যমে। ছয় দফা হচ্ছে সে ভাঙনের হাতিয়ার। সুতরাং ধর্ম রক্ষার জন্য যা পাকিস্তানের সমার্থক এদের শায়েস্তা করতে হবে, পদানত করতে হবে। সৈন্যদেরও বলা হয়েছিল তারা কাফেরদের মোকাবেলা করতে যাচ্ছে (পৃষ্ঠা:-২২) ।
… তাদের উপর টিক্কা খানের এক প্রকার আদেশ বা নির্দেশ ছিল যে, একজন সাচ্চা মুসলমান তার বাবা ছাড়া আর সবার সঙ্গেই লড়াই করবে। কাজেই তাদের যা করতে হবে তা হলো যতোটা পারা যায় বেশি সংখ্যক বাঙালি নারীকে গর্ভবতী করা। এটাই ছিল তাদের কাজের পেছনের তত্ব।”:- ( পৃষ্ঠা-৫৯ )
তিনি তাঁর গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেন যে, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার ডা. জিওফ্রে ডেভিসকে বাংলাদেশে পাঠায়। তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ধর্ষিতাদের নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি মনে করেন ,বাংলাদেশে ধর্ষিতার সংখ্যা ৪ লাখ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজারের মতো হবে।
… গ্রামে গ্রামে তারা সুনির্দিষ্টভাবে মেয়েদের জন্য হানা দিচ্ছে, শহরাঞ্চল থেকে মেয়েদের উঠিয়ে নিচ্ছে, সে এক ভয়াভব অবস্থা। অনেক জায়গায় রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্যরা মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়েছে। ধর্ষিতা নারীদের একটি অংশ আত্মহত্যা করেছে, মেরে ফেলা হয়েছে। একটি অংশের পরিবার পরিজন ধর্ষণের কথা কখনো স্বীকার করেনি সামাজিক কারণে। ফলে সঠিক সংখ্যা কখনো জানা যাবে না। : ( পৃষ্ঠা-৬২-৬৩ ) ।
পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য হানাদার বাহিনী অনেক তরুণীকে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব রক্ষিতা তরুণীদের অন্তঃস্বত্ত্বার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে নয়তো হত্যা করা হয়েছে;- (পৃষ্ঠা-৬৪ )
সুসান ব্রাউনমিলারের উধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন- Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty…girls of eight and grandmothers of seventy-five had been sexually assaulted.
Some women may have been raped as many as eight times in a night. Haw many died from this atrocious (নৃশংস) treatment , and how many more women were murderd as part of the generalized campaign of destruction and slaughter
( জবাই) ,can only be guesses at..( পৃষ্ঠা-৬৪ )
বিকারগ্রস্থ পাকিস্তানি সৈন্যরা শুধু মাত্র যৌনলালসা চরিতার্থের জন্যই নারী নির্যাতন করেনি, একটি জিঘাংসাও চরিতার্থ করেছিল। নিচের উদ্ধৃতি থেকে আরও স্পষ্ট হবে-
” জন হেস্টিংস নামে এক মিশনারী বলেছিলেন , “ পাকিস্তানি সৈন্যরা… মেয়েদের যোনিপথে বেয়নেট ঢুকিয়ে তাদের হত্যা করেছে।” মেয়েদের মসজিদে আটকে রেখেও ধর্ষণ করা হয়েছে। সাতক্ষীরার একটি গ্রামের মসজিদ থেকে বেশ কিছু নগ্ন নারী উদ্ধারের পর এ ধরনের ঘটনা নজরে আসে। এ সমস্ত কিছু বিবেচনায় নিয়ে বলা যেতে পারে ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ছয় লাখের কাছাকাছি হতে পারে বা তার চেয়েও বেশি, কম নয়। ( পুস্তক ঐ, পৃষ্ঠা-৬৯ )”
জনাব মুনাসির মামুন একজন পাকিস্তানির ভাষায় বর্ণনা করেন এই ভাবে যে, “ ঐ সময় আলমদার রাজা ছিলেন ঢাকার কমিশনার। তিনি একটি বই লিখেছেন যাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের অহরহ মানুষ ধরে নিয়ে হত্যার বর্ণনা আছে। হামুদুর রহমান কমিশনের বিবরণ প্রকাশিত হলে তিনি এর বিরুদ্ধে একটি রিট করে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দাবি করেছিলেন। ইসলামাবাদে তিনি এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন, রিটের নবায়ন কালে “ আমি বলছিলাম একটি ঘটনার কথা। চার সৈনিক হামলা করেছে এক বাসায়। বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কন্যাটি অল্প বয়সী, সে হাত জোড় করে করে তাদের জানাল যে, সে মুসলমান,তাকে যেন তারা বোনের মতো দেখে। তারপরও যখন তারা এগিয়ে আসছে তখন সে বলল, আমিওতো পাকিস্তানি। তোমাদের কারও হয়তো আমার মতো মেয়ে আছে। তাও তারা মানছে না। তখন সে বিছানার পাশে কোরান শরীফ রেখে বলল, আমার যদি কিছু করতে চাও তাহলে এই কোরান ডিঙ্গিয়ে করতে হবে। তারা কোরান ডিঙ্গিয়ে ছিল। আমি যখন আদালতে এ বর্ণনা দিচ্ছি তখন সারা আদালত স্তব্ধ। আর বিচারক আমাকে জিজ্ঞেস করছেন বারবার,আপনি যা বলছেন তা কি সত্যি? তাঁর চোখের পানি।” ( পৃষ্ঠা-৮১)
( চলবে)