রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন- পর্ব: ২৯৬:-জালাল উদ্দীন মাহমুদ

Home Page » সাহিত্য » রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন- পর্ব: ২৯৬:-জালাল উদ্দীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার ● ২২ জুন ২০২৩


জালাল উদ্দীন মাহমুদ
তাহমিনাকে নিয়ে লজ্জাকর কাহিনি -৩ (শেষ পর্ব)
এত কিছু ভাবার সময় নাই । হাতে অনেক কাজ। আমি সব কিছু ভুলে কাজ-কর্মে মন দিলাম। কিছু সময় পর দেখলাম –তাহমিনাও লেজারে পোস্টিং দেয়ার কাজ করছে। তবে থেমে থেমে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর তার চোখ দু‘টোও লাল হয়ে গেছে। ভাবলাম আমি তো তেমন কিছু বলি নাই-মেয়ে মানুষ বোধহয় একটু বেশি সেন্টিমেন্টাল হয় । কি রকম সেন্টিমেন্টাল হয় তা অবশ্য টের পেলাম বিকেলে।
বিকেলে লেডিজ কর্নারের ইনচার্জ ও তাহমিনা সহ ৪/৫ জন মহিলা আমার টেবিলের সামনে দাড়াঁলো। ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন আমাকে “ঘেরাও” করেছে।
কি ব্যাপার! আপনারা সবাই একসাথে যে- আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
-আপনার সাথে একটা জরুরী কথা আছে কিন্তু এখানে সবার সামনে বলা যাবে না। লেডিজ কর্নারে আসেন। লেডিজ কর্নারের ইনচার্জ অবিশ্বাস্য ভাবে আজ আদেশের সুরে কথা বলল। ব্যাংক শাখার এক কোনায় লেডিজ কর্নার। আগেই বলেছি মহিলা কাস্টমারগণ এখানে লেনদেন করে। আমি সেদিন মন্ত্রমুদ্ধের মতো তাদের পিছনে পিছনে সে লেডিজ কর্নারে গেলাম। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে কেন ? কি হয়েছে ? তাহমিনাকে এত হতভম্ব দেখাচ্ছে কেন আর ইনচার্জ মহিলাকে গ্রামের অতি বয়স্ক মাতব্বরের মত অতি সাবধানী মনে হচ্ছে কেন? অন্যান্য মহিলারাই বা শাড়ীর আচঁল দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে কেন? এ দৃশ্য আমি কখনই দেখিনি। আমার সাথে মহিলারা বেশ সহজ সরল ভাবে মিশত- হাসিমুখে কথা বলত। আমি কখনই কোন মহিলার সাথে সামান্যতম অসৌজন্যমূলক আচরনও করিনি। তাহলে আজ এমন কি ঘটেছে? তাহমিনাকে কড়া সুরে দুটো কথা বলেছি-এই তো।
আমার ভাবনা ছিন্ন হলো। ইনচার্জ মুখ খুলল- জালাল ভাই, আপনাকে আমরা অনেক ভালো জানি, কিন্তু আজ সকালে কাস্টমারদের সামনে তাহমিনাকে এভাবে কুকথা বলে অপমান করলেন কেন?
-কুকথা ? অপমান? কিসের কুকথা ? কিসের অপমান? আমি অপমানতো করিনি । কুকথা বলার তো প্রশ্নই উঠে না।
-অপমান করেন নাই? কুকথা বলেননি । এরচেয়ে বড় কুকথা আর বড় অপমান একজন মহিলার জন্য আর কি হতে পারে?
-ম্যানেজার স্যার তাহমিনার উপর রেগে আছেন, তাই আমি দুটো কথা বলেছি। হয়তো একটু চিৎকার করে বলেছি। প্রশাসন চালাতে হলে ওরকম মাঝে মধ্যে দু’চারটি কথা বলতে হয়।
-তাই বলে একজন মহিলাকে প্রকাশ্যে এতবড় অন্যায় –কুৎসিত -অশ্লীল-কুকথা বলবেন। অন্তত আপনার কাছ থেকে আমরা কেউ এ রকম আশা করি নাই।
-বুঝতে পারছি না, কী এতবড় অন্যায় -অশ্লীল কথা বলেছি?
-আপনি তাহমিনাকে কেন বললেন, কাপড় খোলেন তো আমি দেখব। একজন মহিলাকে সবার সামনে কাপড় খুলতে বলেন এর চেয়ে বড় অন্যায় , বড় অশ্লীল কথা আর কী আছে ? ইনচার্জ চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল।
-তওবা, তওবা আমি এরুপ কথা কখনই বলিনি !
-বলেছেন, বলেছেন।
-গলায় মাফলার প্যাঁচানো ছিল, আমি বলেছি মাফলার খোলেন তো।আমি দেখব।
-না, আপনি বলেছেন কাপড় খোলেন আমি দেখব।
আমার সামনে সবাই সাক্ষী দিল। আমি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম। তাছাড়া এ ইনচার্জ মহিলা কখনো মিথ্যা কথা বলে না। তাহলে কি আমি মনের ভুলে মাফলারের পরিবর্তে কাপড় খোলার কথা বলেছি। এতো বড় লজ্জার কথা! এখন কীভাবে যে সামলাই!
আমাকে সামলাতে হলো না। ইনচার্জ পরিস্থিতি ট্যাকল দেবার প্ল্যান মনে হয় আগেই করে রেখেছিল। সে ভাষণের ভঙ্গিতে বলা শুরু করল-
জালাল ভাই এ শাখায় এসেছে প্রায় দু’বছর হলো। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ,তাছাড়া মহিলা কর্নার থাকাতে এ শাখায় মহিলা কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বেশি । একটু হাসি ঠাট্টা মশকরা করে বটে তবে জালাল ভাইকে আমি কখনোই কোন মহিলার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে দেখি নাই। রফিক ভাই ও জালাল ভাই অনেক রসিক মানুষ। রফিক ভাই বোধ হয় এখন বাহিরে কোথাও গেছেন। তাকে তো আবার বিকেলে থানারোড শাখায় ক্যাশ জমা দিতে যেতে হয়। সে থাকলে এখনকার এ বিষয়টি নিয়ে সেই কথা বলত। যা হোক জালাল ভাই মুখ ফসকে কাপড় খোলার কথা বলে ফেলেছে। মন থেকে বলে নাই। আর ব্যাংক ভর্তি কাস্টমার , সবার মধ্যে কাপড় খুলতে বলে তার লাভ কি- এ কথা বলে সে অনেকক্ষন হাসল। তার সাথে অন্যরাও হাসল। গুমোট পরিস্থিতি হালকা হয়ে গেছে। হাসির কত গুন। আমার দিক তাকিয়ে ইনচার্জ হাসতে হাসতে বলল- যা হবার হয়েছে। তবে কাল কিন্তু আমাদেরকে আকবরিয়া হোটেল থেকে এনে ২কেজি মিষ্টি খাওয়াতে হবে।
আমি মহা খুশিতে রাজী হয়ে গেলাম। মাত্র ২কেজি মিষ্টিতেই মামলা ডিসমিস। মিষ্টির কত গুন।
তবে এঘটনার পরে অনেকদিন আমার মন খারাপ ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আমি এতবড় একটা ভুল কেমনে করতে পারলাম।
একদিন সামরিক বাহিনীর এক ডাক্তার দম্পতির বাসায় বেড়াতে গিয়ে এ কাহিনিটা তাদের বললাম। কাহিনি শুনে গাইনীকোলজিস্ট ডাক্তার ভাবি হাসতে হাসতে বলল, আমিতো চেম্বারে মহিলা ঢুকলেই বলি-কাপড় খোলেন-শুয়ে পড়েন। দেখি।কই আমার তো কিছু হয় নাই।
তার উদাহরণ শুনে খুব হাসলাম। আর আমার এ দুঃখবোধটাও ভুলে গেলাম। উদাহরণ দিয়ে কথা বলার কত গুণ।
//// //// ////
ছুটি নিয়ে তাহমিনার ভোগান্তির ঘটনায় দ্বিতীয় কর্মকর্তা হিসাবে আমি ছিলাম করন কারক আর ম্যানেজার স্যার কর্তৃকারক। সব কিছুর মূলে ছিল জেনুইন কর্মকারক। তাহমিনা ডাইরেক্ট কাস্টমার সার্ভিস নামক কর্মের সাথে যুক্ত ছিল বিধায় তার দেরিতে অফিসে আগমন সহনযোগ্য ছিল না।
আজ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অনেক মানবিক। ছুটি পাওয়া যায়। তাহমিনার জন্য আজকে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। হায়রে বেচারী ! বাড়ি করার ঋণ পেয়েছিল কিন্তু বাড়ি নির্মাণ করার জন্য নুন্যতম ছাড়ও তাকে প্রদান করা সম্ভব হয়নি। বাড়ি থেকে ছুটির দরখাস্ত পাঠানোর দায়ে সে অভিযুক্ত হয়েছিল । কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারটুকু তাকে দেয়া হয়নি।
তাহমিনা বয়সে আমার অনেক ছোট ছিল। একদিন হঠাৎ শুনলাম সে হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে। চাকরিরত অবস্থায়। হায়রে জীবন- সেই ছুটি মিলল তার- সাধারণ ছুটি নয়, অর্জিত ছুটি নয় একেবারে চিরতরে ছুটি।
সেই লেডিজ কর্নারের ইনচার্জ জাহাঁনুরের কথাও আজ খুব করে মনে পড়ছে। বয়সে সে হয়তো আমার কিছুটা বড় ছিল বা কাছাকাছি বয়সের ছিল। রফিক সাহেবের ব্যাচমেট। রফিক সাহেবের মতই রসিক ও কৌশলী।
রফিক সাহেবের অনুপস্থিতিতে সে অসাধারণ দক্ষতায় সেদিন আমাকে একটা বড় লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করেছিল। বছর কয়েক আগে মনে হয় ২০১৬ সালের দিকে তার পেনশনের তদবিরে আমার অফিসে এসেছিল। আমার সামনে অনেক্ষণ বসেছিল। চেহারের সে জৌলুস কবেই হারিয়ে গেছে। বয়সের ছাপ ষ্পষ্ট । তার দিকে তাকিয়ে আমি দু যুগ আগের লেডিজ কর্নারের দাপুটে ইনচার্জ সে জাহাঁনুরকে খোঁজার চেস্টা করলাম। সে লেডিজ কর্নারের কবেই বিলুপ্তি ঘটেছে। এখন দেখলাম সেযুগের চৌকস জাহাঁনুরও আর নেই। মহাকাল কত পাওয়ারফুল । তার চোখ-মুখের লাবণ্য মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
তবে আজ অন্য একটা কারণে মনটা বেশি খারাপ হচ্ছে । সেদিন আমার উপকার করেছিল জাহাঁনুর আর সে ঘটনার কয়েক মাস পরেই আমার কারণে তাকে আজব এক শাস্তি দিয়েছিল রফিক সাহেব। সে আজব শাস্তির ঘটনাটাও এক সময় শোনাব।
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল ।

বাংলাদেশ সময়: ৮:৪৫:২১ ● ৩৯৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ