আমি দইখাওয়ার গোতামারী ডি এন এস সি হাই স্কুলে এবং হাতীবান্ধা কলেজে পড়েছি। স্কুলটি দইখাওয়াতে হলেও নামটি ছিল গোতামারী হাই স্কুল । স্কুলটির পূর্ণ নাম গোতামারী দ্বারকানাথ সিডিউল কাস্ট হাই স্কুল। আর কলেজটি হলো আলিমুদ্দিন কলেজ। কলেজটি দইখাওয়া হতে প্রায় আট মাইল দুরে, হাতীবান্ধা সদরে অবস্থিত। স্কুলটি এখন চার তলা ভবন। আগের লম্বা টিনের ঘরটিও পূর্ববৎ দন্ডায়মান আছে। সেমি পাকা টিনের লম্বা একটি ঘর। পাশেই এই স্কুলের তৈরী হয়েছে চারতলা নিজস্ব ভবন। টিনের ঘরের আমাদের ক্লাস রুমটি যথারীতি আছে। জানিনা এখনো সেখানে ক্লাস হয় কিনা। আর কি ক্লাসই বা হয়। রয়েছে প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের কক্ষ, আছে মেয়েদের কমন রুম। মেযেরা আমাদের সাথে তখন ক্লাসে বসতো না। কমন রুমে বসে থকেতো। শিক্ষক ক্লাসে আসার সময় শুধু সাথে করে ডেকে নিয়ে আসতেন। ভুল করেও কখনো কোন মেয়ের সাথে কথা বলা যেতো না- সে নিজের বোন হলেও কারো সাথে কথা বলতে দেখা যায়নি। এবার গিয়ে দেখলাম প্রতিটি ছেলে-মেয়ে সাইকেল চালিয়ে গল্প করতে করতে স্কুলে আসছে। আবার ছুটির পর এভাবেই যাচ্ছে।
সেখানে এখন একটি কলেজ হয়েছে ,” দইখাওয়া মডেল কলেজ তার নাম “। কলেজটি সত্যি খুব আকর্ষণীয় ও সুন্দর। চার তলা বিশিষ্ট্য। এতো সুন্দর কলেজ অনেক জেলা পর্যায়েও দেখা যায় না। ফলাফল নাকি শতভাগই কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। অন্যান্য সাফল্যও শতভাগ। ধন্যবাদ জানাই শিক্ষক মন্ডলীকে ,ধন্যবাদ জানাই কলেজ কর্তৃপক্ষকে। যে এলাকাটি সুশিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত ছিল, সেখানে এখন কলেজ হয়েছে অনেক। দইখাওযা মহিলা কলেজ এবং কারিগরি কলেজও রয়েছে একটি করে।
সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সেখানে রয়েছে একটি সীমান্ত রক্ষী ক্যাম্প। নাম দইখাওয়া বি ও পি। আমি পাকিস্তান আমলে দেখেছিলাম ”ইপিআর ক্যাম্প” সম্বলিত সাইনবোর্ড। অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ ক্যাম্প। তখন সেখানে দায়িত্বরতদের অনেকেই ছিল উর্দু ভাষাভাষী লোক। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সাইনবোর্ড বদলে হলো “ বিডিআর ক্যাম্প। অর্থাৎ বাংলাদেশ রাইফেলস ক্যাম্প। এবার গিয়ে দেখা গেলো লিখা আছে বিজিবি ক্যাম্প” । অর্থাৎ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ক্যাম্প। পিলখানার হত্যা কান্ডের পর এই আধা সামরিক রেজিমেন্টের নাম রাখা হয়েছে বিজিবি। আমি এই ক্যাম্পের তিনটি সাইনবোর্ডই দেখেছি। ক্যাম্পটির চতুর্দিকে সুন্দর মাটির দেওয়াল ঘেরা সবুজ বনানী পরিবেষ্টিত। সামনে একটি উঁচু আম গাছ আছে। তার উপর স্থাপিত আছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। পালাক্রমে বিজিবি সদস্যগণ এখানে ডিউটি করেন। ক্যাম্পে টেলিফোনের কোন সংযোগ ছিল না। তবে ওয়্যারলেস সেট স্থাপিত ছিল। একজন বিজিবি সদস্য সংবাদ আদান প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। যন্ত্রটি চালানোর জন্য ব্যটারীর প্রয়োজন হতো। আরও লাগতো পেট্রোলের মতো জ্বালানী। এর পরিচালককে বলা হয় সিগন্যাল মাস্টার। এই ক্যাম্পে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনজন বিহারী সদস্য দায়িত্বরত ছিল। তারা তখনও শান্তিপূর্ণ ভাবে ডিউটি পালন করছিল। কিন্তু পার্শবর্তী কয়েকটি ক্যাম্প থেকে ইপিআর সদস্যরা পালিয়ে গিয়ে পাক আর্মির সাথে যোগ দেয়। সাথে নিয়ে যায় অস্ত্র ও গোলাবারূদ। এই সংবাদে সর্বদলীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্দেশ আসে যে, পাছে ওরা পাক বাহিনীর সাথে যোগদান করে বাংগালী নিধনে প্রবৃত্ব হয়, তাই দইখাওয়া ক্যাম্পের অবাঙ্গালী সদস্যদের মেরে ফেলতে হবে। তখন একজন সুবেদার সহ তিনজন বিহারী সদস্যকে অন্য সব সদস্যগণ গুলি করে হত্যা করেন। সেই অবাঙ্গালী একজন সুবেদার যিনি তখন নির্বিকার একটা সাদা গেঞ্জি গায়ে খাকী প্যান্ট পড়ে তার রুমের দরজার দিকে পিছন দিয়ে বসে ছিলেন। গুলি লেগে তার মাথার খুলি উড়ে গেল। মাথার খুলি সহ গুলি গিয়ে দরজায় লেগে দরজাটি ছিদ্র হয়ে গিয়েছিল। আর একজন সিপাহী আম গাছের আড়ালে বেশ কিছুক্ষণ লুকোচুরির মতো করে জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। এই ভাবে তিন জনকেই মেরে ফেলা হলো। বাংগালী হাবিলদার মোঃ মিন্নত আলী এই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। (চলবে )