গম্ভীরা গান:-১
এটিও একটি লোক গীতি। গম্ভীরা গানের কথা মনে হলেই মনের মধ্যে যে ছবিটি ভেসে উঠে তা হলো অনেক তালিযুক্ত হাফপেন্ট পড়া ও ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে দেওয়া একজন লোক যার মাথায় থাকবে একটি মাথাইল পায়ে ঘুংঘুর। অপরদিকে তার সাথে থাকবে শশ্রুমণ্ডিত মাথাইল পড়া অন্য একজন বয়স্ক মানুষ। বৃদ্ধের হাতে থাকবে একটি লাঠি, যাকে স্থানীয় ভাষায় হালুয়া পেন্টি বলা হয়। তাদের সম্পর্ক হয় নানা-নাতীর। তাদের মধ্যে চলবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কথোপকথন ও হাস্যরস। কিন্তু তার আসল উৎসটি আর একটু ভিন্ন।
গম্ভীরা গান উত্তরাঞ্চলের গান হলেও এটি রংপুর বা লালমনিরহাট অঞ্চলের কোন গান নয়। এটির আদি উৎপত্তিস্থল বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের মালদাহ জেলায়। ধারনা করা হয় যে, গম্ভীরা উৎসবের প্রচলন হয়েছে শিব পূজাকে কেন্দ্র করে। শিবের অনেক নামের মধ্যে একটি নাম হলো “গম্ভীর”। তাই শিবের উৎসব গম্ভীরা উৎসব এবং শিবের বন্ধনা গীতিই হলো গম্ভীরা গান।
মালদহে মূলত চৈত্র সংক্রান্তির শিবপূজা উপলক্ষে বিগত বছরের প্রধান প্রধান ঘটনাবলী নৃত্য, গীত, ও অভিনয়ের মাধ্যমে সমালোচিত হয়। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে ছোট তামাশা , বড় তামাশা, ও ফুল ভাঙ্গা অনুষ্ঠানের গম্ভীরা মুখোশ নৃত্য পরিবেশিত হয়। গম্ভীরা উৎসবের সংগে এ সংগীতের ব্যবহারের পেছনে জাতিগত ও পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে।
গম্ভীরা উৎসব:-কথিত আছে , প্রায় হাজার বছরের পুরনো গম্ভীরা উৎসব এবং তার ধারা বাহিকতা ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মালদহ জেলার জীবনকে প্রভাবিত করে আসছে। পশ্চিম বঙ্গের মালদহ অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির গাজন উৎসবই গম্ভীরা পূজা ও উৎসব নামে পরিচিত। জলপাইগুড়িতে এটি গমীরা নামে খ্যাত। চৈত্রের শেষ চার দিনে মুল অনুষ্ঠান হয়, তবে অঞ্চল ভেদে বৈশাখ ,জ্যৈষ্ঠ এমনকি শ্রাবন মাসেও শিবমূর্তি স্থাপন করে গম্ভীরা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এটি মূলত শিব পূজা নামে খ্যাত হলেও প্রাচীন কালে এটি সুর্যের উৎসব ছিল বলে মনে করা হয়।
মালদহে নিম্ন বর্ণের হিন্দু কোচ রাজবংশী , পোলিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত উৎসবে অংশ গ্রহন করে থাকেন। এই গম্ভীরা উৎসব মালদহ জেলার প্রধানত চারদিনের উৎসব। প্রথম দিন “ঘট ভরা” অনুষ্ঠান। গম্ভীরা মন্ডপে ঘটস্থাপন করে শিব পূজার উদ্বোধন করা হয়। দ্বিতীয় দিনে হয় “ছোট তামাশা”। এই অনুষ্ঠানে শিব ও পার্বতীর পূজা করা হয়। পূজোর অনুষ্ঠানে রঙ তামাশা ,আনন্দ রসিকতার মধ্যে কাটে এবং ঢাক-ঢোল বাদ্য সহযোগে মন্টপে নানা নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। তৃতীয় দিনে “ বড়ো তামাশার সন্যাসীরা শুদ্ধচিত্তে শুদ্ধাচারে কাঁটা ভাঙ্গা ফুল ভাঙ্গা, ও বাণ ফোঁড়ায় অংশ নেয়। এদিন মালদহে বিভিন্ন সঙের দল ঘোরে। রাতে গম্ভীরা মন্টপে মুখোশ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। চামুন্ডা , নরসিংহ, কালীর মুখোশ পড়ে ঢাকের তালে তালে নৃত্য হয়। মুখোশ পড়ে উদ্দাম নৃত্যের মধ্যদিয়ে গম্ভীরার বিশেষ রূপ প্রকাশ পায়। চতুর্থ দিনের উৎসবের নাম ”আহারা” । এই দিন মন্টপে শিবের সঙ্গে নীল পূজাও হয়। সংগে গম্ভীরা গান গাওয়া হয়। বিকেলে বের হয় সঙ। এই সঙ আবার দুইভাগে বিভক্ত। প্রথম রীতিতে গান গেয়ে অভিনয় করা হয়। এখানে সব রকম ভাবে নাটকীয় গুণ প্রকাশ পায়। এই রীতিটিই হলো গম্ভীরা লোকনাট্য।
গম্ভীরা গানের শুরুতে দেবাদিদেব শিবকে বন্ধনা করার রীতি আছে। শিবরূপী অভিনেতাকে মঞ্চে নিয়ে এসে তাঁকে সমস্ত বিষয়ে জ্ঞাত করা হয়। সমাজের মঙ্গলের জন্য কি করণীয় বা কোন সমস্যা থাকলে কি ভাবে তার সমাধান মিলবে এসবের নিদান দেন শিব।
( চলবে)