সাজেদা আহমেদ,বিশেষ প্রতিনিধি; বঙ্গনিউজ :
সারাবছর নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় সুনামগঞ্জের নবগঠিত মধ্যনগর উপজেলার মধ্যনগর বাজারটি হাওরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বানিজ্য কেন্দ্র হিসেবে দীর্ঘবছর ধরে পরিচিতি বহন করে আসছে। উপজেলার সুমেশ্বরী নদী, উব্দাখালী নদী ও গোমাই নদ এই তিনটির মিলনস্থলে শতাধিক বছরেরও বেশি সময় আগে মধ্যনগর বাজারটির সৃষ্টি। প্রায় আধা কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে ও প্রায় দুইশো মিটার প্রস্থে মধ্যনগর বাজারের উত্তরে প্রবাহিত সুমেশ্বরী নদী,পূর্ব ও দক্ষিণে বইছে উব্দাখালী এবং গোমাই নদ। মধ্যনগর বাজারকে কেন্দ্র করে তিনটি নদ-নদী প্রবাহের কারণে দেশের যেকোনো অঞ্চলের সাথে সারাবছর নৌপথের যোগাযোগ একসময় খুবই সহজতম ছিল। একারণেই দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার ব্যবসায়ীদের কাছে বাজারটি বানিজ্যিক ভাবে গুরুত্ব পেত।
মধ্যনগর বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় সোমেশ্বরী নদীর বুকে সারাবছর স্টীমার, জাহাজ চলাচল করতো। কিন্তু এখন সেই দিন আর নেই। শুষ্ক মৌসুমে নদ- নদী গুলোতে এখন আর আগের মত পানি থাকেনা। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে বালি আর পলি পড়ে সুমেশ্বরী নদীর বুকের বেশিরভাগ স্থান জুড়ে জেগে ওঠেছে চর। একইভাবে চর পড়েছে উব্দাখালী, গোমাই নদের বুকে।
স্থানীয়দের মতে, রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক সময়ে খননের অভাবে নদীগুলো নাব্যতা সংকটে পড়েছে। এতে করে নৌপথে পণ্যবাহী কার্গো ও বড় ট্রলারের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বর্ষাকালে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মধ্যনগর বাজারে আসা পণ্যবাহী কার্গো ও ট্রলার বাজারের ঘাটে ভিড়তে পারলেও হেমন্তের ছয়মাসে ছোট ছোট নৌকা চলাচলও কষ্টসাধ্য হয়। তাই এই সময়টাতে (শুষ্ক মৌসুমে) অনেক ব্যবসায়ী নিরুপায় হয়ে সড়ক পথেই অধিক অর্থ ব্যয়ে পণ্য আমদানি করে। যার আর্থিক প্রভাব পড়ে ক্রেতাদের উপর। ফলে স্থানীয় মানুষজন দিনে দিনে পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার কলমাকান্দা বাজার সহ আশপাশের অন্যান্য বাজারমূখী হচ্ছে।
এভাবেই সুমেশ্বরী, উব্দাখালী, গোমাই নদের নাব্যতা সংকটের দরুণ মধ্যনগর বাজার হারাতে বসেছে তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বানিজ্যিক জৌলুস।
মধ্যনগর বাজারের ব্যবসায়ী আবুল বাশার বলেন, মধ্যনগর এখনো দেশের অন্যতম বৃহৎ ধানের বাজার হিসেবে ঠিকে আছে।এই বাজারে সত্তর থেকে আশিটা ধানের আড়ৎ আছে, যা বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় ধানের অভ্যন্তরীণ রপ্তানি চালু রেখেছে।এছাড়া এই উপজেলা থেকে প্রচুর পরিমাণে মিঠা পানির মাছও রপ্তানি হয় ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু সুমেশ্বরী ও উব্দাখালী নদীর নাব্যতা দ্রুত ফেরানোর ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই মধ্যনগর বাজারটি ব্যবসায়ীক ভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। নাব্যতা সংকট দূর করতে দুটি নদীর বিভিন্ন স্থানে বিআইডাব্লিউটিএ’র ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে খননকাজ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়ছে। তবে খননের কাজ পরিকল্পিত ভাবে করা না হলে অল্প দিনের মধ্যেই নৌ চ্যানেল গুলো নতুন বালু ও পলিতে ভরাট হয়ে যাবে।’
ব্যবসায়ী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রিপন সরকার বলেন, ‘মধ্যনগর বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে নৌপথে পণ্য আমদানী করে আসছে দীর্ঘকাল যাবৎ।এসব পণ্য আমদানি করা হয় বড় স্টীলবডি নৌকায়। সুমেশ্বরী নদীর নাব্যতা হারানোর ফলে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ছয়মাস এসব পণ্যবাহী নৌকা আটকে থাকে পাশের ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের সানবাড়ী নামক স্থানে। পরে সেখান থেকে আমদানিকৃত পণ্য খালাস করে ছোট ছোট নৌকায় ঠেলা-ধাক্কায় করে মধ্যনগর পৌঁছায়। এটি ব্যয়বহুল, ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য। তাই মধ্যনগরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্য ঠিকিয়ে রাখতে হলে, সুমেশ্বরী নদীতে মধ্যনগর বাজার থেকে সানবাড়ী পর্যন্ত খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।’
পাশাপাশি উব্দাখালী নদীর গলহা থেকে মধ্যনগর পর্যন্ত খনন করে সারাবছর নৌচলাচল উপযোগী করার কথা বললেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ সরকার। তিনি আরও বলেন, গত বছর উব্দাখালী নদীর কিছু অংশে ড্রেজিং করা হলেও এখন তা বন্ধ রয়েছে। খনন কাজের মানও ভালো হয়নি।
মধ্যনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ হাসান খান বলেন, উপজেলার উব্দাখালী ও সোমেশ্বরী নদী দুটি খননের প্রয়োজনীতা আমি জেলা মাসিক সমন্বয় সভায় উপস্থাপন করেছি। আশা করছি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) অচিরেই নদীগুলো খননের কাজ শুরু করবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী খুশী মোহন সরকার জানান, ‘মধ্যনগরের সুমেশ্বরী নদী সহ সুনামগঞ্জ জেলার ২০টি নদী খননের জন্য বাপাউবো’র গৃহীত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ শেষ পর্যায়ে। আশাকরি অচিরেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।’