১৯৭১ সালে নয় মাস ব্যাপি মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসর নরপশুরা পূর্ব পাকিস্তানের নারী সমাজের উপর ভয়াবহ হত্যা,ধর্ষণ,নির্যাতন চালিয়েছিলো। আমরা সভা সেমিনারে শোনে থাকি, ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও আড়াই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে লাল সবুজের পতাকা খচিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়ছি। কিন্তু সেই নির্যাতিত, ধর্যিত বীরাঙ্গনা নারীদের হাহাকারের কথা ইতিহাসের পাতায় গভীর মমতায় তুলে আনেনি কেউ। তাদের কথা যা লিখা হয়েছে তা যৎসামান্য ও অপ্রতুল। কেন এই অনীহা, তা হলে কি বলবো মহানমুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের অবদান ছিলো না।উত্তরে বলবো অবশ্যই ছিলো। তারা হয়েছিলো নির্মম ভাবে হত্যা,নির্যাতন, ধর্যণের শিকার।
৭১ এ এই নির্যাতিত নারীরা পায় বীরাঙ্গনার খ্যাতি ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ সাহসী নারী বা বীর নারী। বীরাঙ্গনা নারীর সংখ্যা ৪৩৮ জন (গুগল তথ্য)। যাচাই বাছাইয়ের পর ৪২১ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সনদ পায়। বিষয়টি মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে যেমন, অবশ্যই ব্যথাতুর হলেও গর্ব করি অহংকারে।
বিভিন্ন তথ্য উপাত্য, গবেষণা পত্র, দেশী বিদেশী উদ্বৃতি, জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম বিশ্লেষন করলে দেখা যায়– ৭১ এ নারী নির্যাতনের চিত্র ছিলো অমানবিক, নিষ্টুর, ভয়াবহ,পশুতুল্য দানবিক। এপি’র সংবাদ দাতা ৭১এর ২৫ মার্চের গনহত্যার চিত্র তুলে ধরে বলেন–পদ্মা অববাহিকার আকাশ ছেয়ে গেছে শকুনে শকুনে। ইতিমধ্যেই আড়াই লাখ বাঙালির লাশ তারা পেয়েছে খাদ্য হিসেবে।কুয়োর জলে,খানাখন্দে,কচুরি পানার নিচে শিশু সন্তানের চোখের সামনে পঁচছে পিতামাতার লাশ ( উত্তরণ,মার্চ ২০২৩)।
উত্তরণ ম্যাগাজিনে ( মার্চ ২০২৩) প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. জেবউননেছা এর বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা প্রবন্ধটি পর্যালোচনা করলে যুদ্ধকালিন সময়ে আমাদের নারীদের উপর পাকবাহিনী কি বীভৎস নেক্কারজনক নির্যাতন করেছিলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যাবে। আসুন প্রবন্ধটি পর্যালোচনা করি।
অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত নিউজ ম্যাগাজিন পিকস এর তথ্য মোতাবেক ৭১ এ বর্বর পাকিস্তানি দ্বারা এদেশে ত্রিশ লক্ষ নারী ধর্যিত হয়েছে (১৫ জুলাই ১৯৭২,দৈনিক ইত্তেফাক)। মানবতাবাদী গবেষক ড. জিওফ্রে ডেভিস বলেছেন — ধর্ষনের ফলে প্রায় ২ লক্ষ অন্তঃসত্ত্বা মহিলার মধ্যে ১ লক্ষ ৭০ হাজার গর্ভপাত ঘটিয়েছে গ্রাম্য হাতুরে ডাক্তারের মাধ্যমে।অবশিস্ট ৩০ হাজারের মধ্যে অধিকাংশ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে(প্রবাহ,৬ নভেম্বর ১৯৯৭)।
৭১এ নির্যাতনের বড় কেন্দ্রস্থল ছিলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন। যুবতী মেয়েদের এখানে এনে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ট্রাক থেকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে তাদের উলঙ্গ করে মাটিতে ফেলে কুকুরের মত ধর্ষণ করতো। এই নির্যাতন কি মেনে নেয়া যায়। শুনলেও রক্ত গরম হয়ে পড়ে।
৭১এ ২৫ সে মার্চে পাকসেনারা বাড়ি ঘর থেকে বাঙালি শিশু,নারী,বৃদ্ধাদের টেনে রাস্তায় ফেলে জবাই করে।রমনীদের রাস্তায় ফেলে উলঙ্গ করে ধর্ষণ করে।অতঃপর ধারালো ছুরি দিয়ে স্তন ও পাছার মাংস কেটে ফেলার পর নির্মম ভাবে হত্যা করে। কাউকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলার পর গোপনস্থানে লোহার রড ঢুকিয়ে,কারও গায়ে আগুন দিয়ে হানাদার সেনারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ( মুক্তিযোদ্ধে নারী সমাজ)। এর চেয়ে জগন্য নির্যাতন আর কি হতে পারে।
এ ছাড়াও পুর্বপাকিস্তানের তথা বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর বন্দরে,গ্রামে গঞ্জে,পাড়া মহল্লায় বর্বরতম হত্যা নির্যাতন করেছিলো পাকিস্তানি ও তাদের দালালরা। চট্টগ্রামের বৌদ্ধ অধ্যুষিত গ্রামে প্রায় ১০০০ বৌদ্ধ নারীকে ধর্যন করে (যুদ্ধ ও নারী)। ৭১এ রংপুরে ১০ হাজারের অধিক কুমারীর সতিত্ব হরন করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা(দৈনিক আজাদ, ২২ফব্রুয়ারী ১৯৭২)। রাজশাহীর বাঁশবাড়িয়া গ্রামে দেড়’শ মা বোনকে ঘর ধেকে টেনে বের করে প্রকাশ্য দিবালোকে লোকজনের সামনে লাঞ্জি্ত করে।এদের মধ্যে ১০ জনই ঘটনাস্থলে মারা যায়।
সৈয়দপুরে টেকনিক্যাল কলেজে কমপক্ষে ৬০০ থেকে ৭০০ জন আটক নারীর উপর পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করা হয়( যুদ্ধ ও নারী) । কুমিল্লার শাহপুরে এক মুসলিমলীগ নেতার বাড়িতে তিন শতাধিক নারী বন্দি ছিলো বলে জানা যায়। কুটি বাজারে একজন, হরিয়াবহ ও কুতুব মিয়ার বাড়িতে ২০ জন নারী নির্যাতিত হয়েছে (যুদ্ধ ও নারী)।যশোহর ক্যান্টনমেন্টে ২৯৫ জন নারীকে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়।
গাইবান্ধায় দালালরা মেয়ে বউদের বাড়ি থেকে জোরজুলুম করে বের করে নিয়ে পাক সেনাদের ভোগের সামগ্রী হিসেবে পাঠাতো ( দৈনিক আজাদ,২৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২)। দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ থানায় হানাদার বাহিনীর হাতে ৭ হাজারেরও বেশী মহিলা ও শিশু নিহত হয়, ৫০০ মহিলার সতীত্ব হরণ করে ( দৈনিক আজাদ,২৪ জানুয়ারী ১৯৭২)।বরিশালে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাসীরনিকে বর্বররা নৃশংস ভাবে হত্যা করে ( মুক্তিযুদ্ধে নারী)।
৭১ এ নির্মম ভাবে নারী নির্যাতন ও হত্যার ইতিহাস অনেক লম্বা চওড়া যা বলে শেষ করা যাবে না।কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে তাদের ধর্ষণ নির্যাতনের বিভৎস্যতার কথা লিখলে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস তা কোন দিন অস্বীকার করতে পারবে না।
এই নির্যাতিত নারীদের যথার্ত মর্যাদা দেয়ার উদ্দ্যেশে বীরাঙ্গনা খেতাব প্রদান করেন ১৯৭২ সালে ২২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই বীরা
ঙ্গনাদের পুর্ণবাসনের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন নারী পূর্ণবাসন বোর্ড। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন - কেউ যদি বীরাঙ্গনাদের পিতৃ পরিচয় জানতে চায়, বলে দিও তাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার। এ ভাবে নির্যাতিতাদের পুর্নবাসনের দায়িত্ব গ্রহন করেন বঙ্গবন্ধু।অনেক দেরিতে হলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন। শুধু যুদ্ধ নয়,জাতীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল অঙ্গনেই নারীরা রাখছে গর্বময় অবদান।আসুন সাধুবাদ জানাই তাদের অবদানকে, নারীও মানুষ, দেই তাঁর স্বীকৃতি।
লেখকঃ উপদেষ্ঠা মন্ডলির সভাপতি,বাংলাদেশ কৃষকলীগ,কেন্দ্রীয় কমিটি।