বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালে ১৭ মার্চ গোপালপুর জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। বাবা লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের তৃতীয় সন্তান তিনি। তাঁরা ছিলেন দুই ভাই ও চার বোন। মধুমতি নদীর তীরে টুঙ্গি পাড়া গাঁয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিলো বাঙালির স্বাধীনতার গৌরব গাঁথার জন্ম দেয়ার জন্য।
তথ্য উপাত্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়–বঙ্গবন্ধু কখনও অলস সময় পাড় করতেন না। তাঁর নিজস্ব কোন পেশা ছিলো না। তাঁর বাবা, স্ত্রী ও শুভাকাঙ্ক্ষিদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য, সহযোগিতা পাইতেন। তিনি অর্থ কষ্টে পড়লেও রাজনীতির কর্মসূচি বাদ দিতেন না।উর্ধ্বশ্বাসে সব সময় ছুটাছুটি করতেন বাঙালির মুক্তির জন্য, সাধারন জনমতকে সুসংগঠিত করতে। কারাগারে বন্দি জীবনেও ছিলো মহা ব্যস্ততা। নিজে তৈরী করে কখনও পরিচিত কারাবন্দিদের চা মুড়ি খাওয়াতেন, তাদের সাথে হাসি খুশী সখ্যতা রাখতেন, ফুলের বাগান পরিচর্চা করতেন।
তিনি একজন ভালো পাঠক ও লেখক ছিলেন। কারাগারে বসে অনেক নামী দামী লেখকের বই পড়তেন। এ কারণেই জন্ম দিতে পেরেছিলেন – অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন নামক বিখ্যাত তিনটি প্রবন্ধ গ্রন্থের। কারাগারের অভ্যন্তরে থেকেও রাজনৈতিক বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। জাতীয় রাজনীতির সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সহযোদ্ধাদের পরামর্শ, নির্দেশনা বা সিদ্ধান্ত দিতেন। ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে তার নিজ বাড়িতে, জনগনের সামনে গেইটের পাশে চেয়ারে বা দু’তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতেন। জনগণের আত্মার আত্মীয় হয়ে রাজনীতি করতেন।
বঙ্গবন্ধু শিশু বয়সে ও যৌবনে অত্যন্ত সাহসী,মেধাবী, দুষ্টু প্রকৃতির, সত্যবাদী, মানবদরদী,একগুয়ে স্বভাবের ছিলেন। ভয় ভীতি বলে কিছুই ছিলো না তার চেতনায়। নেতৃত্বের সমস্ত গুনাবলীই তাঁর চরিত্রে ছিলো। মারপিটও তিনি করতে পারতেন।বঙ্গবন্ধুর ছোট বেলার বন্ধু মালেককে হিন্দু
মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যার্নাজির বাড়ি থেকে বৃটিশ পুলিশের উপস্তিতিতে দরজা ভেঙ্গে কেড়ে নিয়ে আসেন। এর জন্য মামলা হয়। পুলিশ বঙ্গবন্ধু কে ধরে নিয়ে যেতে আসলে, ফুফাত ভাই বলেছিলো — মিয়া ভাই পাশের বাসায় একটু সরে যাও না। বঙ্গবন্ধু সরে গেলেন না, বরং বললেন –যাব না,পালাবো না।লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি। বাবা লুৎফর রহমান জিঞ্জেস করেছিলেন — মারপিট করেছ? বঙ্গবন্ধু চুপ করে থেকে সত্য স্বীকার করছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর পিতা ছলনার আশ্রয় নেননি বা লুকোচুরি করেননি। তিনি পুলিশকে বলেছিলেন – আপনি নিয়ে যান।মারপিটের ঘটনায় দোসী সাব্যস্থ করে তখনকার সরকার কিশোর বঙ্গবন্ধুকে কতিপয় বন্ধুসহ কারাগারে প্রেরণ করে। অনেক দেন দরবারের মাধ্যমে সাত দিন পর জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেড়িয়ে আসেন।এটাই ছিলো তাঁর জীবনের প্রথম কারাবরণ ( ১৩ পৃষ্টা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। ক্ষতিপূরণ হিসেবে পনের শত টাকাও দিতে হয়েছিলো।
১৯৩৭ সালের দিকে গোপালগঞ্জে মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করা হয়েছিলো। এই সমিতি মুসলিস গরিব ছেলেদের সাহায্য করতো। বঙ্গবন্ধু বলেছেন – প্রত্যেক রবিবার মুষ্টি ভিক্ষার চাল ওঠাতেন সকল মুসলিম বাড়ি থেকে। এই চাল বিক্রি করে গরিব মুসলিম ছেলেদের বই এবং পরীক্ষা ও অন্যান্য খরচ দিতেন (পৃষ্টা ৯’ অসামাপ্ত আত্মজীবনী)। সেই সমিতির সাধারন সম্পাদক ছিলেন তিনি। যদি কোন মুসলিম পরিবার চাল দিতে না চাইতো, বঙ্গবন্ধু তার দলবল নিয়ে তাদের উপর জোড় প্রয়োগ করতেন ও প্রয়োজনে তাদের বাড়ীতে রাতে ইট নিক্ষেপ করতেন।
১৯৩৮ সালে প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক
ও শ্রমমন্ত্রী শহিদ সহোরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন মিশন স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সহোরাওয়ার্দী সাহেব মিশন স্কুল পরিদর্শনে এলে, সহপাঠিদের সঙ্গে নিয়ে মার্জিত অথচ প্রতিবাদী ভাষায় কিছু দাবিদাবা উপস্থাপন করেন। উপস্থাপনের কৌশল দেখে সন্তুষ্ট হয়ে সকল দাবিই পুরণ করেন। সেই থেকে তৈরী হয় সোহরাওয়ার্দি সাহেবের সঙ্গে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সখ্যতা। এই মহান নেতার কাছে রাজনৈতিক দীক্ষা নেন বঙ্গবন্ধু।এরপর পর থেকেই ছিলো গুরু- শির্ষ্যের পথ চলা রাজনৈতিক অঙ্গনে। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ দাতা ও মাথার ছায়া হয়ে কাজ করতেন শহিদ সাহেব। তখন থেকেই রাজনীতির দ্বার খুলে যায় বঙ্গবন্ধুর,আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
স্কুলে তিনি ক্লাশ ক্যাপ্টেন ছিলেন।খেলাধূলার প্রতি তাঁর খুব ঝোঁক ছিলো।হকি,ভলিবল,ফুটবল ইত্যাদি খেলা করতেন তিনি। ভালো গান গাইতে ও ব্রতচারি করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মিশন স্কুল ক্লাবের সেক্রেটারী।তাঁর বাবা লুৎফর রহমান ছিলেন অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারী। তাদের টিমের মুখোমুখি খেলা হলে জনসাধারন খুব উপভোগ করতো। খেলতে গিয়ে বাপ বেটা কেউ কাউকে পড়োয়া করতো না। বরং করতো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।
যুগে যুগে বহু মনিষী পৃথিবীতে এসেছে, তাঁরা সভ্যতার উন্নত কাঠামো বিনির্মানে যুগিয়েছে অনুপ্রেরণা, দিয়েছে দিকনির্দেশনা। মেধা শ্রম, ঘাম ব্যয় করেছে,কেউ কেউ রক্ত দিয়েছে, এমন কী জীবন উৎসর্গ করছে মানব কল্যাণে। তাঁরা স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছেন মানব সভ্যতার বিশ্ব খ্যাত ইতিহাসে।যেমন -পেট্রিক হেনরির অমর বাণী ছিলো give me liberity or give me death (1775).আব্রহাম লিংকনের বিখ্যাত ভাষনটি Gettysburg adress(1863) হিসাবে বিশ্ব খ্যাত। উইনষ্টন চার্চিলের ভাষ্য ছিলো We shall fight on the beaches(1940),মার্টিন লুথার কিং বলতেন I have a dream(1963). তাঁরা মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখানোর পাশাপাশি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ বাঙালিকে উপহার দিয়েছেন। অমর হয়েছেন কাব্যকথায়,গানে, গল্পে,বাঙালির ঐতিহাসিক অভিধানে।
১৯৪৩ সালের কথা বলছি, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো। ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিলো। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মনের চাল চল্লিশ বা পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করতো।মানুষ খেতে না পেয়ে রাস্তা ঘাটে মরে পড়ে থাকতো।খাদ্যাভাবে মানুষের গন মরণ ঠেকাতে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিলো।
বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন –ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন বাংলাদেশ দখল করে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন বাংলার এতো সম্পদ ছিলো যে,একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনে ফেলতে পারতো।সেই বাংলাদেশের দুরাবস্থা দেখেছি চোখে যে,মা মরে পড়ে আছে,ছোট বাচ্চা মরা মায়ের দুধ চাটছে।কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি করছে।
আরো বলেছেন –ছেলে মেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গিয়েছে।পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়ে বিক্রি করার চেস্টা করছে।কেউ কিনতেও রাজী হয়নি।বাড়ির দোয়ারে এসে চিৎকার করছে, মা বাঁচাও,কিছু খেতে দাও,মরে তো গেলাম, আর পারি না,একটু ফেন দাও।এই কথা বলতে বলতে ঐ বাড়ির দুয়ারের কাছেই মরে গেছে ( পৃষ্টা ১৮’ অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। সেই ভয়াবহ দুর্দিনে বঙ্গবন্ধু সেবার হাত প্রসারিত করে জনগনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এভাবেই শেখ মুজিবুর রহমার হয়েছেন বঙ্গের বন্ধু,বিশ্ববন্ধু,জাতির পিতা, অমর কাব্য, হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি, জাতির জনক, স্বাধীনতার স্বপ্ন দ্রষ্ট্রা ও ঘোষক, রাজনীতির কবি, মুক্তিযুদ্ধের মহা নায়ক। এতো বিশেষণে বিশেষায়িত বা সঙ্গায়িত করতে বঙ্গবন্ধুকেই মানায়। রাজনীতির প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক ও আগ্রহ দেখে বঙ্গবন্ধুর পিতা বলেছিলেন –বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করবো না,পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা,তবে লেখা পড়া করতে ভুলিও না।লেখা পড়া না করলে মানুষ হতে পারবে না।আর একটা কথা মনে রেখো –sincerity of perpose and honesty of perpos থাকলে জীবনে পরাজিত হবে না (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।
বঙ্গবন্ধুর সাহস ও বুক ছিলো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইল লম্বা চওড়া। বুলেট বোমাকে ভয় পেতেন না।রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত গর্জে ওঠে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দিয়েছিলেন অগ্নিঝরা মুক্তির ভাষণ। ২৬ মার্চ ১৯৭১ এ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলেই নয় মাস রক্তাক্ত যুদ্ধের পর ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ১৬ ডিসম্বর ১৯৭১ এ পেয়েছি স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারী রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব গ্রহন করেন বঙ্গবন্ধু।সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পর কেউ কি জানতো মীরজাফরের গুলিতে নির্দয় নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হবে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বাংলার রুপালী চাঁদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।এখান থেকেই ইতিহাস জিকজাক পথে হাঁটতে শুরু করে।
কেউ কেউ ভেবেছিলো বঙ্গবন্ধু হয়তো বা ইতিহাসের শিরোনাম বা পৃষ্টা হবেন।কিন্তু না, বঙ্গবন্ধু হয়েছেন ইতিহাসের পুরো অধ্যায়।হয়েছেন poet of politics.তাই তো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এতো গর্ব অহংকার করি। বিশ্ব জোড়া খ্যাতি তাঁর। কেউ পারবেনা তাঁর সুনাম,অবদান মুছে দিতে। মুজিব থাকবে, আছে সারা বাংলার ঘরে ঘরে, বাঙালির ইতিহাস,ঐতিহ্য,সংস্কৃতি ও চেতনায়।
লেখকঃ উপদেষ্টা,বাংলাদেশ কৃষকলীগ।
০১৭১৭৭৬২৭৪৫
চলবে —