বঙ্গ-নিউজঃ একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল অংশ জনসাধারণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। যেটি কার্যকরভাবে পরিচালিত করতে পারলে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্জন নিশ্চিত হয়। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে কিছু থাকলেও শহরাঞ্চলে সরকারিভাবে প্রাথমিক কোনো কাঠামো গড়ে ওঠেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সমন্বয়হীনতা একদিকে যেমন রোগীর বিপর্যয়মূলক চিকিৎসা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জনে বড় বাধা হিসাবে দাঁড়িয়েছে। এখনই প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে জোর দিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। না হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত চ্যালেঞ্জ হবে।
এমন প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের মতো আজ দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০২৩। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘হেলথ ফর অল অর্থাৎ সবার জন্য স্বাস্থ্য’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজের মাধ্যমে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তারা সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ-যাতে মানুষ আর্থিক অসুবিধা ছাড়াই প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো সহজে পেতে পারে।
তবে সংস্থাটির সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৩০ ভাগই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পায় না এবং প্রায় দুইশ কোটি মানুষ ভয়াবহ স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্ত বলছে, এক্ষেত্রে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার (পিএইচসি) ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সবচেয়ে কার্যকরী এবং ব্যয়সাশ্রয়ী পদক্ষেপ হিসাবে ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে নানা ধরনের সংক্রামক, অসংক্রামক রোগের বিস্তার বাড়ছে। এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ হচ্ছে ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ ব্যয়কে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এখন যেভাবে চলছে তাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, দেশে ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ (ইউএইচসি) বা সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় জোর দিতে হবে। কিন্তু সবাই মানসম্পন্ন সেবা পাচ্ছে না। বৈশ্বিক ইউএইচসি র্যাংকিংয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০-এর মধ্যে ৫১তম। ইউএইচসির দুটি অংশ প্রিভেন্টিভ বা প্রতিরোধমূলক অন্যটি কিউরেটিভ বা আরোগ্যমূলক। ইউএইচসি অর্জন করতে হলে প্রাইমারি কেয়ার প্রিভেন্টিভ লক্ষ্যমাত্রা স্কোর ৮০তে উন্নীত করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তর একই মন্ত্রণালয়ভুক্ত হওয়ার পর তাদের একই ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে জনবল ও সরঞ্জাম না থাকায় কেউ প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীনে থাকবে গ্রাম এবং শহরের সব মানুষের জন্য পরিবার কল্যাণ ও পুষ্টিসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। এক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং পরিবার কল্যাণ সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো একীভূত করে উপজেলা বা থানা পর্যায়ের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। অন্যটিকে মেডিকেল শিক্ষা এবং সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেবা বিভাগে পরিণত করা যেতে পারে। পাশাপাশি সব সমন্বয়হীনতা ও দীর্ঘসূত্রতা দূর করার লক্ষ্যে নতুন দুই বিভাগের কাজের সঙ্গে সমন্বয় জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে বিলুপ্ত বা পুনর্গঠন করতে হবে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সব ক্ষেত্রে মেডিকেল প্রফেশনালদের পদায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ‘জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেছে। সেখানে দেখা যায়, দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৩ শতাংশ আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য। এছাড়া হাসপাতালগুলোয় অবকাঠামো সংকট, অন্যায্য সুবিধাভোগীদের প্রভাব, নিরাপত্তার অভাব, নীতি সম্পর্কিত ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ডব্লিউএইচও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক পরিচালক পুনম ক্ষেত্রপাল সিং বলেন, ২০১৪ সাল থেকে টেকসই স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের জন্য সব দেশের সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে অঙ্গীকার করেছিল। করোনা মহামারির কারণে সেটি থেকে ফিরে আসে। প্রায় তিন বছর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ অপরিহার্য স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে অক্ষম হচ্ছে।
ফলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের দ্বিতীয় বৈঠকে ডব্লিউএইচও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অর্জন বিষয়ে এ অঞ্চলের নীতিনির্ধারক এবং কর্মসূচি ব্যবস্থাপকদের রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রতিশ্রুতি পূরণের আহ্বান জানিয়েছে।