নজরুল-জীবনের শেষ অধ্যায় - অন্তহীন দুঃখ-কষ্টেরই এক আখ্যান-৭
ঢাকার ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ সরকার একটি নির্দিষ্ট সরকারী বাসভবনে সরকারী সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের বোধশূন্য জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। ১৯৭৪ সনের ২২ ফেব্রুয়ারী কোলকাতায় কবির ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক দিয়ে কবিকে সম্মান জানালো। একই বৎসর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘাতক বাহিনীর দ্বারা নৃশংসভাবে নিহত হলেন। জারি হলো জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। তার সাথে সাথে কবি নজরুল ইসলামের জীবনও আর নিরঙ্কুশ মসৃণ রইলো না। শোনা যায় যে সেনাবাহিনীর কোন পদস্থ কর্মকর্তার পছন্দের তালিকায় ছিল কবি নজরুল ইসলামকে দেওয়া সেই সরকারী বাসভবনটি। ১৯৭৫ সালের ২২শে জুলাই পরিকল্পনা মাফিক হঠাৎই কবিকে অসুস্থ সন্দেহ করে সেই বাস ভবন থেকে তুলে নিয়ে সরকারী হাসপাতালে ( বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ) ভর্তি করে দেওয়া হয়। জড়বৎ মানুষটিকে শুইয়ে দেওয়া হলো হাসপাতালের কেবিনে। প্রশস্ত বাসভবনের আঙ্গিনা থেকে তাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো ছোট্ট একটা খাঁচার মধ্যে। পারিপার্শিক অবস্থার এই পরিবর্তনের ফলে কবির দেহে আকষ্মিক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসলো। প্রায় এক বছর হাসপাতালের কারাগারে কাটানোর পর জ্বর-নিউমোনিয়া জাতীয় রোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ,বিজ্ঞানের সব অস্ত্রকে ব্যর্থ করে জীবন্মৃত এই দেহটিকে ধীরে ধীরে মৃত্যু এসে গ্রাস করলো। দিনটি ছিল ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট, রবিবার, সকাল দশটা-দশ মিনিট । এই মহাজীবনটি চিরকালের জন্য থেমে গেলো।
কবির একটি ইসলামী গানে এক সময় তিনি লিখে ছিলেন, “ মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জ্বিনের আযান শুনতে পাই”। তাঁর গানের এই লাইনগুলো তুলে ধরে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন নজরুল অনুরাগী ও অনুগামী সরকারের কাছে প্রস্তাব দেন যে, বাংলাদেশেই এবং একটি মসজিদের পাশে কবি নজরুলকে সমাধিস্থ করা হোক। বলাবাহুল্য তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার সেই প্রস্তাবে সম্মতি দিলে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনবর্তী মসজিদ সংলগ্ন স্থানে সমাধিস্থ করা হয়। উল্লেখ্য, কবিকে তাঁর জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিয়ে আসা হয়ে ছিল এই প্রতিশ্রুতিতে যে, কবিকে আবার তাঁর জন্মভূমিতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তখন কেউ স্মরণ করলেন না যে, কবির স্ত্রী প্রমীলা দেবী এক সময় কবির শেষ শয্যাপাশে সমাধিস্থ হবার বাসনা প্রকাশ করে ছিলেন। তাছাড়া কারো মনে পড়লো না যে, একটি গানে কবি নজরুল ইসলাম এটিও লিখেছিলেন যে,
তোমার কবরে মোর তরে একটু রাখিও ঠাঁই
মরণে যেন সে পরশ পাই গো, জীবনে যা পাই নাই ।”
প্রমীলা দেবীর এই শেষ ইচ্ছে যিনি স্মরণ করাতে পারতেন তিনি অর্থাৎ তাঁর ছেলে কাজী সব্যসাচী তখন দমদম বিমান বন্দরে বিমান বিভ্রাটে আটকে গিয়েছিলেন। নিয়তি বুঝি এখানেও বিরূপ হলো। এখানেও কবির অন্তিম বাসনা অতৃপ্তই রয়ে গেল। পরে সব্যসাচী বিমানে যখন ঢাকায় পৌঁছালেন তখন মাটির শেষ আস্তরণটি কবির কফিনটিকে ঢেকে দিয়েছিল। ন্যুন্যতম শেষ ইচ্ছেটিও আর পূরণ হলো না। অনেক পরে অবশ্য ঢাকার সেই পবিত্র সমাধী থেকে মাটি নিয়ে বর্ধমানের চূরুলিয়াতে প্রমীলা দেবীর সমাধীর পাশে রেখে কবি নজরুল ইসলামের ইচ্ছেকে সম্মান জানানো হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে যায় অন্নদাশংকর রায়ের সেই সময়ের “ বিদ্রোহী রণক্লান্ত” নামে একটি কবিতার ক’টি লাইন-
কেউ জানলো না ইতিহাসের ফের
ভুল হয়ে গেল বিলকুল
এতকাল পরে ধর্মের নামে
ভাগ হয়ে গেল নজরুল।”
তথ্যসূত্র-
১। নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়- সূফী জুলফিকার হায়দার।
২। নজরুল জীবনী- অরুন কুমার বসু।
৩। গল্পসল্প।
৪। উইকিপিডিয়া।
( প্রসঙ্গক্রেমে চলে আসা নজরুল সম্পর্কে লেখা এখানেই শেষ হলো। পরে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে সামান্য কিছু লিখতে ইচ্ছে রাখি। )