নজরূল -জীবনের শেষ অধ্যায় - অন্তহীন দুঃখ-কষ্টেরই এক আখ্যান-১
১৯৪২ সালের ১০ই জুলাই। কবি নজরুল ইসলাম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি একটি চিঠি লিখে ছিলেন তাঁর সব সময়ের ছায়া সঙ্গী কবি জুলফিকার হায়দারকে। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “ প্রিয় হায়দর , তুমি এখই চলে এসো। অমলেন্দুকে পুলিশ আজ অ্যারেস্ট করেছে। আমি কাল থেকে অসুস্থ। ইতি –নজরুল। তাং- (উপরে) ৭-১০-৪২ । লক্ষণীয় যে, চিঠিতে কবি তারিখটি লিখেছেন ৭-১০-৪২ । আসলে তারিখটি হবে ১০-৭-৪২ । আর একটি কথা হলো চিঠিটি যখন কবি লিখে ছিলেন, তখনও পর্যন্ত কিন্তু অমলেন্দু দাসগুপ্ত , যিনি ছিলেন “ দৈনিক নবযুগ” পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ,তাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেনি । অনেক পরে তিনি অ্যারেস্টেড হয়ে ছিলেন। অর্থাৎ কবি যে সেদিন আকষ্মিক ভাবে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছিলেন, রোগাক্রান্ত হয়েছিলেন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও সবাই জানেন যে, আরও অনেক আগে থেকেই কবির মধ্যে অনেক অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। অর্থাৎ রোগের আক্রমণ অনেক আগে থেকেই সবার অলক্ষ্যে তাঁর মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে ছিল। যাই হোক, সেদিন কবির চিঠি পেয়ে জুলফিকার হায়দার একটুও সময় নষ্ট না করে সোজা উপস্থিত হলেন কবির ১৫/৪, শ্যাম বাজার স্ট্রীটের কবির বাস ভবনে। দোতলার তাঁর ছোট্ট ঘর। বিছানায় নিঃস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন কবি। তাঁর ডান হাতটা কাঁপছে। কখনও বেশী কখনও কম। চেহারা বিমর্ষ, বিষন্ন। স্বাভাবিক ভাবে চেহারার যে উজ্জ্বলতা দেখা যায় তার চিহ্ন মাত্র কোথাও নেই। একদম নির্জীব । দীপ্তিহীন। কবির পাশে বিছানায় পড়ে আছেন রুগ্ন-শীর্ণ কবিপত্নি প্রমীলা দেবী। প্রায় আট বছর আগে থেকেই প্যারালাইসিসে পঙ্গু হয়ে তিনি বিছানায় শয্যাশায়ী। কিছুক্ষণ পরেই ঘরে ঢুকলেন বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত আই এমএস, বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডি এল সরকার। কবিকে বললেন, কি ব্যাপার ? শরীরটা কি ভাল নেই ? কি কষ্ট হচ্ছে ? কবি তাঁর ডান হাতটা ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাতের অসাঢ়তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, “ হাতটা কাঁপছে “। এই ছোট্ট কথাটিও তিনি কিন্তু সুস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করতে পারলেন না। অস্পষ্টভাবে এবং জড়িয়ে জড়িয়ে কথাক’টি বললেন। ডাক্তার বাবু বললেন, এটা কি প্রথম অ্যাটাক্ট ? আগে কি কখনও এরকম হয়েছে ? কবি নীরব। গিরিবালা দেবী বললেন, “ নূরুর কোন অসুখই কোন দিন দেখিনি । আজ দেখুননা, কথা বলতেই নূরুর কষ্ট হচ্ছে। “
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ডাক্তার ডি এল সরকারের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা চললো। কিন্তু রোগের প্রকোপ কমলো না। বরং জিভ আগের চেয়ে বেশি জড়িয়ে যাচ্ছিল। হাত কাঁপা কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। কবি মাঝে মাঝেই ভীষণ ক্ষীপ্ত হয়ে উঠছেন। তাঁর সেই উগ্রমূর্তি ভয়ানক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। মোটের উপর অসুখের তীব্রতা দ্রুত বেড়েই চললো। ইতিমধ্যে বিভিন্ন খবরের কাগজে নজরুলের এই আকষ্মিক শরীর বিপর্যয়ের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আশা করা হয়েছিল যে, ভারত বিখ্যাত এই কবি, বাঙালীর প্রাণের কবি , কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই অসুস্থতার খবরটি পেয়ে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা ,তাঁর ভক্তরা সবাই দলে দলে ছুটে আসবেন। কিন্তু না , কেউ আসলেন না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের কাছে তিনি পরিত্যাক্ত। বাঙ্গালীর প্রাণে বিদ্রোহের আগুন লাগিয়ে ছিলেন যিনি, শ্যামাসঙ্গীতের পাশাপাশি ইসলামিক সঙ্গীতে ঝড় তুলেছিলেন যিনি, অসম্ভব জনপ্রিয় সব নজরুল সঙ্গীত লিখে সুর দিয়ে যিনি বাঙ্গালীর সঙ্গীত জগৎকে, বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক জগৎকে সমৃদ্ধ করেছিলেন, আলোকিত করেছিলেন, সেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ অবস্থায় কাউকে কাছে পেলেন না। ঘরে তাঁর অসুস্থ পঙ্গু স্ত্রী- তার চিকিৎসার জন্য,ঔষধপত্রের জন্য টাকা দরকার। দুই ছেলে কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ তাদের বেঁচে থাকার জন্য টাকা দরকার। বাড়িতে আশ্রিত আরও তিনজনের সঙ্গে আছেন শ্বাশুরী গিরিবালা দেবী ,সেই সংসার চালানোর জন্য টাকা দরকার। সর্বোপরি তাঁর নিজের চিকিৎসার জন্য, ঔষধপত্র কেনার জন্য টাকা দরকার। কিন্তু সেই নিদারুণ সূচনীয় অবস্থায় তিনি কারও কাছ থেকে কোন রকমের আর্থিক সাহায্য পেলেন না। ১৯শে জুলাই ,তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক সাহেবের নিকট কবি নজরুল ইসলামের অবস্থা জানানো হলো। কিন্তু শুনে সবাই বিষ্মিত হবেন যে, হক সাহেব কবির রোগাক্রান্ত সেই অবস্থাকে মোটেই গুরুত্ব দিলেন না। ( চলবে )