কাজী নজরুল; বহু বিশ্রুত ও বিস্ময়কর এক প্রতিভা: পর্ব-১
উপরোল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে নজরুলের সুবৃহৎ কর্ম কান্ড, তাঁর মনোবৃত্তি, তাঁর দেশপ্রেম, তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ব্রিটিশদের বিরোদ্ধে তাঁর অবস্থান এই সব বিস্তারিত বর্ণনা একত্রে ও সার্বিক ভাবে উপস্থাপন করলে নজরুলের আদর্শ , প্রকৃতি ইচ্ছা তাঁর বিদ্রোহী হবার কারণ সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়া সম্ভব। তাই আরও একটু লিখতে প্রয়াস পাচ্ছি। সম্মানীত পাঠক, আপনারা আশাকরি ধৈর্য হারা হবেন না।
নজরুল ছিলেন যুগস্রষ্টা কবি। তিনি একটি নতুন যুগের অগ্রপথিক তুর্য বাদক। তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল নিপীড়িত মানুষের বন্ধন মুক্তির গান। প্রচলিত রীতি ও বিধানকে তিনি অবহেলায় দৃপ্ত পদসঞ্চারে দলিত করলেন, গাইলেন নিপীড়িত মানবাত্মার জয়গান। তিনি রাজভয় সমাজভয় ধর্মীয় বিধানের ভয় পরিহার করে দৃপ্ত তেজে মানব মহিমার স্তোত্র রচনা করলেন। দৃপ্ত কন্ঠে বললেন-
বল বীর
চির উন্নত মম শির।
অবনত মস্তক উচ্চে তুলে দাঁড়াবার সাহসী দৃপ্ত উচ্চারণে তিনি বাংলা কাব্যের লালিত মধুর পেলবতাকে পরিহার করলেন, আনলেন বিদ্রোহের বাণী। রাজার বিরুদ্ধে , অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তিনি মাথা তুললেন। মাথা তুললেন সমাজের ভন্ডামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তাই তাঁর বিদ্রোহ শুধু রাজার বিরুদ্ধে নয়, মানবতার শত্রুর বিরুদ্ধেও।
নজরুল ছিলেন সৈনিক- একাধারে অস্ত্র সৈনিক ও ভাষা সৈনিক। প্রথম মহাযুদ্ধে সৈনিক বেশে তিনি যুদ্ধে গিয়ে ছিলেন। সেখানে থাকতেই তিনি মানবতার ক্ষত-বিক্ষত রূপটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর সারা অন্তর জুড়ে আগুন জ্বলে উঠে ছিল। তাই “ বিদ্রোহী “র মতো অভিনব কবিতা তিনি লিখলেন। হঠাৎ করে মানুষ তাঁর আপন সত্তার জাগরণ অনুভব করলো। পরাধীনতার শৃংখল মুক্তির গান রচনা করলেন নজরুল। সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা রচনা করলেন। ধর্মীয় ভন্ডামীর স্বরূপ উন্মোচিত করলেন। শোষণ নির্যাতন ,নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতায় অগ্নিঝরা বাণী শাণিত করে তুললেন। কবিতাকে করে তুললেন সংগ্রামী হাতিয়ার। বাংলা কবিতার ললিত মধুর রূপ তিনি পাল্টে দিলেন। সম্পূর্ণ নতুনভাবে ও বিদ্রোহে কবিতাকে করে তুললেন শাণিত, রচনা করলেন মানব মুক্তির পদাবলী। বাংলা কাব্যের ভাব বলয়ে যে রোমান্টিক চেতনা এতদিন সক্রিয় ছিল তা হঠাৎ করে পরিবর্তিত হয় রৌদ্ররসে, রুদ্র তেজে দীপ্ত হয়ে উঠলো। কবি মাটির মানুষের কথা বললেন। মানব মুক্তির কথা, শৃংখল মুক্তির কথা ধ্বনিত করলেন তাঁর কাব্যে। বাংলা কবিতায় নতুন হাওয়া নতুন আমেজ তিনি নিয়ে এলেন “ বিদ্রোহী “ কবিতার মাধ্যমে। “ বিদ্রোহী “ কবিতা প্রকাশিত হবার পর পরই তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে চিহ্নিত হলেন। তাঁর কবিতার উদ্দীপনাময় বাণী পরাধীন জাতির চেতনায় এক নতুন বোধের জন্ম দিল। তিনি দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করলেন-
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিশ
আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্নিশ।
দাস মনোভাবের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন চিত্ত মানুষের জাগরণী দীপ্ত পদাবলী তিনি রচনা করলেন। স্পষ্টতই ঘোষণা করলেন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে জেহাদ। তিনি অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, মানব মুক্তির গান গেয়েছেন; শৃংখল মুক্তির দীপ্ত বাণী উচ্চারণ করেছেন। ধর্মীয় ভন্ডামীর এবং ইহার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এবং সকল প্রকার সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নির্ভয় বাণী ঝংকৃত করেছেন। সে জন্যে তাঁকে “বিদ্রোহী “ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ( চলবে )