রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলাম-১০
অসংখ্য রচনাতে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় মিলে। ধর্ম নিয়ে গোড়ামীর তিনি ছিলেন একদম বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথও তাই। এ প্রসঙ্গে নজরুলের “মসজিদ ও মন্দির” নামক প্রবন্ধ থেকে দু”একটি উদ্ধৃতি দিতে চাই।
এই প্রবন্ধের শুরুতেই নজরুল লিখেছেন,
” “ মারো শালা যবনদের,” মারো শালা কাফেরদের” । আবার হিন্দু মুসলমান কান্ড বাধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা কাটাকাটি তারপর মাথা ফাটাফাটি, আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লাহ এবং মা কালীর “প্রেস্টিজ” রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চীৎকার করিতে ছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম তখন আর তাহারা আল্লা মিয়া বা কালী ঠাকুরানির নাম লইতেছে না। হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া আর্তনাদ করিতেছে- “ বাবাগো, মাগো” । মাতৃপরিত্যক্ত দুটি ভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে।
দেখিলাম, হত আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষান দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদি চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল।
মন্দির-মসজিদের ললাটে লেখা এই রক্তকলঙ্ক –রেখা কে মুছিয়া ফেলিবে, বীর ? একই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “ যে সব অবতার–পয়গম্বর মানুষের মার হইতে মানুষকে বাঁচাইতে আসিয়া মানুষের মার খাইয়া গেলেন, তাহারা আজ কোথায় ? মানুষের কল্যাণের জন্য আসিয়া ছিলেন যাঁহারা,তাঁহাদেরই মাতাল পশু শিষ্যেরা আজ মানুষের সর্ব অকল্যাণের হেতু হইয়া উঠিল। যিনি সকল মানুষের দেবতা ,তিনি আজ মন্দিরের কারাগারে, মসজিদের জিন্দাখানায়, গির্জার Goal এ বন্দি। মোল্লা-পুরুত, পাদরি-ভিক্ষু জেল- ওয়ার্ডের মত তাহাকে পাহারা দিতেছে। আজ শয়তান আসিয়া বসিয়াছে স্রষ্টার সিংহাসনে।
তিনি আরও লিখেছেন- আমি ভাবি,যখন রোগ-শীর্ণ অনাহার ক্লিষ্ট বিবস্ত্র বুভুক্ষু সর্বহারা ভুখারিদের দশলক্ষ করিয়া লাশ দিনের পর দিন ধরিয়া ওই মন্দির-মসজিদের পাশ দিয়া চলিয়া যায় , তখন ধসিয়া পড়েনা কেন মানুষের ওই নিরর্থক ভজনালয় গুলো? কেন সে ভুমিকম্প আসেনা পৃথিবীতে ? কেন আসেনা সেই রুদ্র-যিনি মানুষ সমাজের শিয়াল-কুকুরের আড্ডা ওই ভজনালয়গুলো-ফেলবেন গুঁড়িয়ে-দেবেন মানুষের ট্রেড মার্কার চিহ্ন ওই টিকি-টুপিগুলো উড়িয়ে ?
নজরুল ছিলেন একান্তভাবেই মানুষের কবি। দেশ-মাতৃকার কবি। লেখার বিষয়টি অনিচ্ছা সত্বেও একটু বিস্তারিত লেখার প্রয়োজনীয়তা হয়ে গেছে।
নজরুলকে সামনে রেখে নজরুল জয়ন্তি পালনের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে বঙ্গবন্ধু কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তখন কবিকে ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কবি এই বাস ভবনেই ছিলেন। বাড়িটির নামকরণ হয় “ কবি ভবন” নামে। কবিকে জাতীয় ও রাষ্ট্রিীয় পর্যায়ে আমাদের জাতীয় কবি হিসাবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়, জাতীয় আর্কাইভ ,নজরুল ইন্সটিটিউট ও বাংলা একাডেমির কোথাও নজরুলকে জাতীয় কবি হিসাবে ঘোষণা করা সংক্রান্ত সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন বা অন্য কোনো দলিল পাওয়া যায়না। বিষয়টি নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রজ্ঞাপন জারি করা বিশেষ প্রয়োজন। এতে আমাদের নিজেদেরকেই সম্মানিত করা হবে। দৈন্যতা দুর হবে। ( চলবে )