বঙ্গ-নিউজ : যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের আশায় বাংলাদেশী নাগরিকরা বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি এমনকি দালালদের সহযোগিতা নিয়ে থাকেন।
বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও কিছু চক্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা গ্রাহকদের থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে নানা প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে।
গত শুক্রবার প্রতারণার মাধ্যমে ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম উত্তর বিভাগ।
জালিয়াতির এই বিষয়টি সবার আগে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের নজরে আসে গত ১৮ই জানুয়ারি।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সিকিউরিটি এটাশে মাইকেল লি বাদি হয়ে গুলশান থানায় ওই দুই পাসপোর্টধারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা আবেদনের জন্য দুটি পাসপোর্ট জমা পড়ে।
পাসপোর্ট দুটির তথ্য তদন্ত করতে গিয়ে দূতাবাস জানতে পারে, আবেদনকারীরা পাসপোর্টটি গুরুত্বপূর্ণ দেখাতে মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া ও ক্যাম্বোডিয়া ভ্রমণের জাল এন্ট্রি এবং এক্সিট সিল বসিয়েছে।
পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় ঢাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক চক্রটিকে শনাক্ত করে এবং ছয় জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত চারটি জাল সিল ও তিনটি পাসপোর্ট জব্দ করা হয় বলেও দাবি করেছে পুলিশ।
গ্রেফতারদের মধ্যে দুইজন ছিলেন আবেদনকারী এবং বাকি চারজন দুটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক নাহলে কর্মী ছিলেন বলে পুলিশ জানায়।
প্রতারণা হয়েছে যেভাবে
পুলিশ বলছে আমেরিকার ভিসা পেতে, প্রত্যেক গ্রাহকের সাথে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় চুক্তি করতো এই দুটি এজেন্সি। এভাবে প্রতারণা করে চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
আড়াই বছর ধরে তারা এই জালিয়াতির ব্যবসা চালিয়ে আসছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এ ছাড়াও আমেরিকার ভিসা বা নাগরিকত্ব পেতে আরও বিভিন্ন প্রতারণার খবরও পুলিশ জানতে পেরেছে।
ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে জানান, “তারা হয়তো ভেবেছে অন্য দেশের ভিসা থাকলেই ইউএস ভিসা পেয়ে যাবেন, কোনো তদন্ত হবে না। কিন্তু অন্য দেশের ভিসা থাকলেই আমেরিকার ভিসা হবে, এমন কোনো গ্যারেন্টি নাই। এসব মিথ্যা তথ্য দিয়ে দালাল বা এজেন্সিরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।”
তবে যারা ট্রাভেল এজেন্সির কাছে ভিসা পেতে টাকা দিয়েছে তারাও সমান অপরাধী বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে পুলিশ জানায়, গ্রেফতাররা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেতে আগ্রহীদের সাথে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় চুক্তি করতো। পাসপোর্টের গুরুত্ব বাড়াতে বিভিন্ন দেশের জাল ভিসা এবং জাল সিল পাসপোর্টে সংযুক্ত করতো। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার জন্য মার্কিন দূতাবাসে সেই জাল সিল/ভিসা সংযুক্ত পাসপোর্ট জমা দিতো।
এরই মধ্যে গ্রেফতার ছয় জনের বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে ডিবি।
এ চক্রের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারে তাদের অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানা গিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নাহলে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের জানিয়ে বা না জানিয়ে এই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো জাল ভিসা সরবরাহ করতো।
পরে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা সব টাকা পরিশোধের পরও জাল ভিসার কারণে শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত দেশে যেতে পারতেন না।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সতর্কতা, করণীয় কী
ভিসা জালিয়াত চক্র গ্রেফতার হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ২০শে জানুয়ারি এ বিষয়ে সতর্কতামূলক বিবৃতি দিয়েছে।
সেখানে তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা আবেদন করার জন্য কোনো এজেন্সি বা দালালের সহায়তার প্রয়োজন নেই।
যুক্তরাষ্ট্র ভিসা আবেদনকারীরা নিজেরাই অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন।
এজন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য ও নির্দেশিকা যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ওয়েবসাইটে দেয়া আছে।
মার্কিন ভিসা আবেদনকারীরা ভিসা আবেদনপত্রে যে তথ্য দেয়, সাক্ষাৎকারে তারা যে নথি দেয়, তার দায়ভার আবেদনকারীর হওয়ায় নিজের আবেদন নিজে দেয়ার ব্যাপারেই উৎসাহ দেয় দূতাবাস।
এক্ষেত্রে মূলত চারটি বিষয়ে তারা গুরুত্ব দিয়েছে, সেগুলো হলো: মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটের সব তথ্য পর্যালোচনা করা, প্রয়োজনীয় ও সঠিক ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে সাক্ষাৎকারের জন্য প্রস্তুত থাকা, ভিসা প্রক্রিয়া এবং সাক্ষাৎকারের সময় নির্ভুল উত্তর দেওয়া।
ভিসা আবেদনে মিথ্যা তথ্য ও নথি উপস্থাপনের ফলে শুধু ভিসা প্রত্যাখ্যানই নয়, প্রার্থীর অযোগ্যতাও বিবেচিত হতে পারে, যা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বড় বাধা হতে পারে বলে বিবৃতিতে সতর্ক করা হয়।
‘ভিসা দেয়া’ বা ‘ভিসা ফি’ এর নামে প্রতারণা থেকে সতর্কতা
মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটে প্রতারক চক্রের ভুয়া বার্তা থেকে সতর্ক থাকতে নানা নির্দেশনা দেয়া থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের “ভিসা ফি” নেয়ার নাম করে বিভিন্ন প্রতারক চক্র ফোন কল, ইমেইল এবং চিঠির মাধ্যমে অননুমোদিত প্রক্রিয়ায় অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এবং সম্প্রতি এমন প্রতারণার সংখ্যা বেড়েছে বলে সতর্ক করেছে মার্কিন দূতাবাস।
দূতাবাসের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে যে, প্রতারক চক্র তাদের প্রধান ফোন লাইনের নম্বর নকল করতে পারে।
ফলে এমন কোনো নম্বর থেকে প্রাপ্ত ফোন কল ও বার্তা মূল অফিস থেকে করা হয়েছে বলে আবেদনকারীদের মনে হতে পারে।
এই কল ও মেসেজগুলোর পিছনের প্রতারকেরা অর্থ হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশে নিজেদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকে।
সেক্ষেত্রে ইমেইলের দিকে দৃষ্টি দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দূতাবাস জানায়, তাদের ইমেইলের ঠিকানা “.gov” দিয়ে শেষ হয়।
সে কারণে এবং “.gov” দিয়ে শেষ হয়নি এমন কোন ইমেইল থেকে আসা ভিসা-বিষয়ক যেকোনো চিঠিপত্রকেই সন্দেহজনক বলে বিবেচনা করতে হবে।
দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়, ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস কখনই আবেদনকারীকে ভিসা ফি প্রদান করার অনুরোধ জানিয়ে ইমেইল বা কল করবে না।
ভিসা সাক্ষাৎকার সবসময় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে ব্যক্তিগতভাবে নেয়া হয়, ফোনে নয়, এবং কনস্যুলার সেকশন কখনই বিকাশ, নগদ, রকেট বা অনুরূপ ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে ভিসা ফি প্রক্রিয়া করে না।
অন-ইমিগ্রেশন ভিসা আবেদনকারীরা তাদের ডিএস-১৬০ অনলাইন ফর্ম পূরণ করার পর শুধুমাত্র ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল)-এর শাখায় তাদের ভিসা ফি জমা দিতে পারেন।
ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস নিয়মিতভাবে ভিসা সহায়তা দেয়া বিষয়ক প্রতারণামূলক প্রস্তাব, ই-মেইল, চিঠি, ওয়েবসাইট, ফোন কল, এসএমএস এবং বিজ্ঞাপন পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাথে যুক্ত নয় এবং এমন কোন সেবা দেয়ার জন্য দূতাবাস তাদের অনুমোদন, সনদ দেয়নি বলে জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার আবেদনের জন্য ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।