বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি জেলার নিম্নাঞ্চল হাওর এলাকা হিসেবে পরিচিত। মিঠাপানির মাছ, নানা জাতের গুল্ম- লতা, বৃক্ষ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি এই হাওর এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান।বাংলাদেশে উৎপাদিত চালের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ আসে বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান থেকে। আর উৎপাদিত বোরো ধানের শতকরা ২০ ভাগ পাওয়া যায় হাওরাঞ্চল থেকে।
২০১৭ সালে ভারতীয় পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট আগাম বন্যায় হাওরের ১০ লাখ মেট্রিক টন পাকা ধান পানির নিচে পচে নষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যাপক ফসলহানির পর হাওর নিয়ে সারা দেশে আলোচনার ঝড় উঠে। হাওরের খবর প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছিল। এরপর মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাওরে ছুটে আসেন। নানামুখী সরকারি-বেসরকারি তৎপরতায় পরিস্থিতি বদলেছে অনেক। ঠিকাদারি প্রথা বাতিল হয়ে এখন সব হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে। হাওরবাসী আশা করেছিল এরপর ফসল রক্ষা নিয়ে তাদের আর হয়তো ততটা ভাবতে হবে না। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সংকট কাটেনি। এখনো সময়মতো প্রকল্প হয় না, বাস্তবায়ন কমিটি হয় না। বাঁধের কাজ সময়মতো শুরু হয় না, সময়মতো শেষ হয় না। তবে ২০১৭ সালের পর কোনো কোনো এলাকায় ফসলহানি হলেও সমগ্র হাওরএলাকার ফসল হারানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এর কারন ২০২২ সাল পর্যন্ত বোরো মৌসুমে হাওরে ফসলহানির বড়ধরনের বন্যা সৃষ্টি হয়নি।
এদিকে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জেলা ও উপজেলা বাঁধ মনিটরিং কমিটি।এরফলে কিছুটা আশার আলো সঞ্চারিত হলেও বাঁধ ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখনো পুরোপুরি স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিতে পৌঁছতে পারছে না হাওরবাসী।
হাওরের ফসল সুরক্ষিত রাখতে সরকার ২০১৭ সালে সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা প্রণয়ন করে। কাবিটা নীতিমালায় উল্লেখ আছে, ‘পরিচালক, পওর পরিদপ্তর, বাপাউবো, ঢাকা প্রাপ্ত সব স্কিমের একটি তালিকা বোর্ডের অনুমোদন সাপেক্ষে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দাখিল করবেন। নীতিমালার ৪৯-এ “দাখিলকৃত স্কিমসমূহ ৩০ অক্টোবরের পরেই বরাদ্দ ও বাস্তবায়নের কার্যক্রম অনুমোদন পূর্বক ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পিআইসি গঠন ও কাজ শুরু করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি কোনো বছরই।
গতবছর বর্ষা মৌসুমে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় হাওরের জনজীবন বিপর্যস্থ হওয়ার পাশাপাশি হাওরের ফসল রক্ষার বাঁধ গুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এ বছর হাওরের পানি নামছে দেরিতে। এখনো কোনো ডেডলাইনই মানা হয়নি। নির্ধারিত সময়ের এক মাস অতিবাহিত হতে চলেছে, তবুও পুরোপুরি বাঁধে কাজ শুরু হয়নি। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ পর্যন্ত ১২টি উপজেলা থেকে ৯১৩টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত জেলা কমিটিতে জমা হয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদন হয়েছে ৫৮০টির। বাকি ৩৩৩টি প্রকল্পের এখনো অনুমোদন হয়নি। অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে কাজ চলছে ১৭৫টিতে। বাকি ৪০৫টিতে এখনো কাজই শুরু হয়নি। যেগুলোতে শুরু হয়েছে, সেগুলোতেও কাজের গতি কম। গত এক মাসে কাজের অগ্রগতি কত শতাংশ, এর কোনো উত্তর নেই বাঁধ নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন ও তদারককারীদের কাছে।
প্রথম দিকে ডেডলাইন মিস করলে বাকি ডেডলাইন ঠিক রাখা যায় না। দেরিতে কাজ হলে বন্যার সময় বাঁধের মাটি নরম থাকে এবং পানির তোড়ে সহজেই বাঁধ ভেঙে যায়। একদিকে বোরো ধান রোপণ করতে বিলম্ব হচ্ছে, অন্যদিকে অকালবন্যার সময় দিনকে দিন এগিয়ে আসছে। তাই শুরু থেকে সতর্ক থাকতে হবে। দেরিতে পানি নামায় দেরিতে ধান রোপণ করা হবে। স্বাভাবিকভাবে দেরিতেই ধান পাকবে। তাই সঠিকভাবে ফসল ঘরে তোলা নিয়ে হাওরের কৃষকের মনে ভয় কাজ করছে। হাওরের ইতিহাসে দেখা যায় সাধারণত কয়েক বছর পরপর একটা বড় অকালবন্যা হয়। সেই ঐতিহাসিক সত্য হাওরবাসীকে আরো ভাবিয়ে তুলছে। এ ক্ষেত্রে হাওরের পানি নিষ্কাশন পথ বা নালা সমূহ নিয়মিত সংস্কার না করায় কৃষি মৌসুমে হাওরের পানি সরছেনা। এই কাজটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের দ্বায়িত্বের মধ্যে পড়লেও তাদের অবহেলা পরিলক্ষিত হয়।
সমস্যা শুধু সময়ের ক্ষেত্রে নয়। সমস্যা রয়েছে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও। কাবিটা নীতিমালা ২০১৭-এ স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে প্রকাশ্যে গণশুনানি করে পিআইসি গঠন করতে হবে। ২০১৮ সালে এর কিছু বাস্তবায়ন দেখা গেছে। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালে গণশুনানি অনেক জায়গায় ঠিকই হয়েছে, কিন্তু বিগত বছরগুলোর মতো এবারেও পিআইসি গঠিত হচ্ছে সংসদ সদস্যের পছন্দের লোকদের দিয়েই। অথচ সংসদ সদস্য এই কমিটির সদস্য নন, একজন উপদেষ্টা মাত্র। এতে রাজনৈতিক অনেক হিসাবনিকাশের কারণে বিগত সময়ে সংশ্লিষ্ট হাওরে জমি নেই বা কৃষক নন এমন লোকও পিআইসির সদস্য হয়েছেন। যার সবই নীতিমালার লঙ্ঘন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে দু-একজন সদস্য বেশি প্রভাব খাটান। বাকি সদস্যরা তাদের কথামতো দস্তখত করে যান। এতে সবার মতামত প্রতিফলিত হয় না ।
কোথায় বাঁধ হবে এবং কত টাকা খরচ হবে
সেই বিষয়গুলো নির্ধারণ করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা। সেক্ষেত্রে অনেক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। একদিকে হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ, অন্যদিকে বাঁধ হওয়া দরকার এমন সব জায়গায় বাঁধ হচ্ছে না। কোথাও কোথাও অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।গত ৭ জানুয়ারী ২০২৩ তারিখে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার দেখার হাওরে জেলা প্রশাসক জেলা হাওররক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি সরেজমিনে গিয়ে প্রায় এক কোটি টাকার হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করার নির্দেশ দিয়ে এসেছেন।
এরপর তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলার ‘গুরমা হাওর বর্ধিতাংশ উপ-প্রকল্প’ নামের প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। গত ১৪ জানুয়ারী২০২৩ তারিখে জেলা প্রশাসক উক্ত প্রকল্পটি সরেজমিনে পরিদর্শনকালে এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে স্থানীয় কৃষক, জনপ্রতিনিধি ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এসময় প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা ও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে বলে উপস্থিত সকলেই একমত প্রকাশ করেন। সেখানে উপস্থিত কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দিলীপ কুমার সোম জানান, এ বাদ পরা প্রকল্পের আওতায় চার’শো হেক্টর কৃষিজমি রয়েছে।পরে জেলা প্রশাসক এই প্রকল্পের একটি ক্লোজার বন্ধ করা সহ ক্ষতিগ্রস্থ অংশের মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। তাহলে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বাদ পরার তালিকায় উঠলো কিভাবে? অন্যদিকে ‘গুরমার হাওর উপ- প্রকল্প’ নামে মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রাম থেকে চাপাইতি গ্রাম পর্যন্ত তিনটি পিআইসি গঠন করে নির্মাণ করা হচ্ছে বাঁধ। যা জনচলাচল ছাড়া হাওরের ফসল রক্ষায় কোনো কাজেই আসবেনা। এ ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পটি অনুমোদন পেলো কিভাবে?এসব প্রশ্ন এখন ঘোরপাক খাচ্ছে জনমনে।
এখন আসি বাঁধ নির্মাণে আরও কি ঘটছে সেসব বিষয়ে।কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের ৫০ মিটার দূর থেকে মাটি কাটার কথা থাকলেও বেশির ভাগ বাঁধের ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাঁধের পাড় থেকে মাটি কেটে বাঁধ দেয়া হয়। এতে বাঁধ দুর্বল হয়।বাঁধে একটি নির্দিষ্ট ঢাল থাকার কথা (২:১), কিন্তু অনেক বাঁধই খাড়া থাকায় পানির তোড়ে সহজেই ভেঙে যায়। ড্রেজার মেশিনে বাঁধের কাছ থেকে মাটি কেটে বাঁধ নির্মাণ করার কারণে অনেক বাঁধ দুর্বল হয় এবং সহজেই ভেঙে যায়।
‘কাবিটা’ মানে ‘কাজের বিনিময়ে টাকা’। এই কর্মসূচী বাস্তবায়নে হাওর জনপদের দরিদ্র জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান হবার কথা। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকেই বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় শ্রমিকের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে মাটি কাটার যন্ত্র। এসব যন্ত্রের দ্বারা বাঁধের একবারে কাছ থেকে মাটি কেটে বাঁধে ফেলায় বাঁধের ভিত্তি দূর্বল হচ্ছে, বাঁধগুলো ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পরেছে।বর্তমানে অধিকাংশ বাঁধের আশেপাশে মাটি নেই বলেই চলে। সময় স্বল্পতা আর শ্রমিকের অভাব বলে নীতিমালা উপেক্ষাকরে এই যন্ত্রের ব্যবহার জায়েজ করার মিথ্যাবুলি আজ হাওরবাসীর জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে।
হাওর এলাকা এমনিতেই নিচু এলাকা। বছর বছর বাঁধের জন্য মাটি কাটার ফলে যেসব জায়গা একটু উঁচু ছিল, তা-ও নিচু হয়ে যাচ্ছে। তাই এখন অনেক হাওরে বাঁধ নির্মাণের জন্য দূর থেকে নৌকায় বা যান্ত্রিক পরিবহনে করে মাটি আনতে হয়। এতে সময় যেমন বেশি লাগে, খরচও তেমনি বেশি হয়। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এই সংকট আরো বাড়বে। তাই দ্রুত এর সমাধান বের করতে হবে।খুঁজতে হবে অন্য কোনো বিকল্প।
পানিকে তার স্বাভাবিক পথে চলতে দিলে এই পানি ক্ষতির কারণ হতো না। পলি ও বালি পড়ে হাওর ও নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ার কারণে পানি ছড়িয়ে পড়ে ক্ষেত-খামারে। এই পলি ও বর্জ্যের সবচেয়ে বড় উৎস উজানে ভারতীয় পাহাড়। হাওর এলাকায় আগামবন্যার একমাত্র কারন এই উজানের ঢল বা পাহাড়ী ঢলের পানি। দিনের পর দিন পাহাড়ে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের নামে যত্রতত্র অপরিকল্পিত খনন ও প্রাকৃতিক বনভূমি উজার করার ফলে প্রতিবছর আরো অধিক পরিমানে পাহাড়ী মাটি ও বালি হাওরের ভূপৃষ্টে এবং নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে। এরফলে দ্রুত হাওর ও নদীর তলদেশ ভরে উঁচু হয়ে চলছে।
হাওর সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য জীববৈচিত্র্যের অস্থিত্ব রক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট গুরুত্ত্বপূর্ণ কিছু হাওর বাদ দিয়ে হাওর ও নদী সমূহ খননের কোনো বিকল্প নেই। সীমিত পরিসরে নদী খনন শুরু হয়েছে। সেখানেও অনিয়ম - দূর্ণীতির অভিযোগ উঠছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে তা বন্ধ করে হাওর ও নদী খনন কাজ আরো ব্যাপকভাবে করতে হবে।
কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করে কিছু স্থানে স্লইচ গেট নির্মাণ করা দরকার। এতে হাওরে পানি প্রবেশ রোধ করা যায় এবং প্রয়োজনে হাওরের পানি বাড়ানো বা কমানো যায়। তবে স্লইচ গেটের ব্যবস্থাপনা যথাযথ হতে হবে। কিছু হাওরের স্লইচ গেট অকেজো পড়ে আছে। স্থানীয় অনেকের অভিমত কালভার্ট দিয়েও পানির হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এতে প্রয়োজনে কালভর্টের মুখ বন্ধ করতে হবে এবং প্রয়োজনে খুলে দিতে হবে।সেই সাথে কৃষিমৌসুমে হাওরের পানি নিষ্কাশনের নালা খনন করতেই হবে।
হাওরের বাঁধ ভাঙার একটি অন্যতম কারণ হলো বাঁধের ভেতর দিয়ে প্রবহমান ছোট পানির ধারা। স্থানীয়ভাবে একে বলে ফুলকা। এই ফুলকার কারণে বাঁধ দুর্বল হয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে পানির চাপ পড়লে বাঁধ সহজেই ভেঙে যায়। যদি আগেভাগে বাঁধের মাঝখানে অপারেশন করে এসব গর্ত বন্ধ করা হয়, তবে বাঁধ ভাঙার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। এ বিষয়টি স্থানীয় কৃষকরা অনেকবার বললেও পানি উন্নয়ন বোর্ড আমলে নিচ্ছে না। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর এসব সুপারিশকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ অর্থলোভী মানুষ পিআইসি গঠন করে অপেক্ষায় থাকে কোনোভাবে কাজ না করে টাকা লোপাট করার জন্য। এদেরকে চিহ্নিত করে পিআইসির জন্য অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। দেখাযায়, হাওরে জমি নেই অথচ তাদের নিয়ে গঠন হয় পিআইসি। অথবা অপেক্ষাকৃত দূর্বল কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয় নামসর্বস্ব পিআইসি, যার সমস্থ নিয়ন্ত্রন থাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার কিংবা ভিন্ন এলাকার প্রভাবশালী লুটেরাদের কাছে। এছাড়াও অনুগত কৃষকদের দিয়ে পিআইসি গঠন করে অনুমোদন পাইয়ে দেবার জন্য লবিং কস্ট বাবত মোটা অংকের টাকা লেনদেন হয়।
গতবছর ধর্মপাশা উপজেলাতে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এনামূল হক শামীম হাওর পরিদর্শনে এলে স্থানীয় কৃষকদের পক্ষথেকে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বিক্রি বা পিআইসি বানিজ্যের অভিযোগ উঠে স্থানীয় সংসদ সদস্যের পরিবারের বিভিন্ন সদস্য ও তার অনুসারী নেতাদের বিরুদ্ধে। যা বিভিন্ন গনমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, স্থানীয় অসৎ রাজনৈতিক দূর্বৃত্ত ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের চিহ্নিত করে হাওরের ফসলরক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণের মতো স্পর্শকাতর কাজের বাইরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।সুষ্ঠুভাবে ও সময়মতো কাজ শেষ করার জন্য বাঁধের কাজ অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দিয়ে অনিয়ম বন্ধ করতে হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আগের মামলাগুলোর অগ্রগতি অগ্রগতি নিয়ে জনমনে অসন্তোষ ও সন্দেহ রয়েছে। পিআইসি যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করে তা নিশ্চিত করতে হলে সময়মতো অর্থ ছাড় করতে হবে। এজন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করতে হবে। পিআইসিদের চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
যুগ যুগ ধরে যেভাবে বাঁশ-টিন দিয়ে বাঁধ রক্ষা করা হতো, এখনো কৃষকরা তার থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে বাঁধ রক্ষায় কীভাবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়, তা ভেবে দেখতে হবে। এজন্য গবেষণা জরুরি।
বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িতদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে তাদের ওপর সামাজিকভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, উন্নয়নকর্মীর সমন্বয়ে ‘সামাজিক বাঁধ মনিটরিং কমিটি’ গঠন করলে আরো বেশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।সুষ্ঠুভাবে ও সময়মতো বাঁধের কাজ শেষ করার জন্য বাঁধের কাজ অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।তদবির, সুপারিশ বন্ধ না হলে সঠিকভাবে কিছুই করা যাবেনা। গত ৭ জানুয়ারী সুনামগঞ্জের মিটিংয়ে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, দেশের বাইরে থেকেও পিআইসি নিয়ে সুপারিশ আসে তার কাছে। এ বক্তব্য থেকে পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়। তাই জেলা পর্যায়ের কমিটিকে শক্ত অবস্থান গ্রহন করতে হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারগনের জন্য মাঠ পর্যায়ে চাপমুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।
সর্বোপরি এই বাঁধ বা ফসলের ওপর যাদের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে, সেই কৃষকদের অধিকার সচেতন করা পর তারা নিজেরাই নিজের অধিকার আদায় খুবই জরুরি।উপকারভোগী প্রকৃত কৃষকদেরকে এই রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়নের বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহন করতে হবে।সকল শ্রেণী- পেশার হাওরবাসীকেই এসকল নেতিবাচক অপ-তৎপরতা মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।
সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা-২০১৭ প্রবর্তনের ফলে আগের চেয়ে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ কিছুটা ভালো হচ্ছে বলে কৃষকরা জানান। তবে নির্ধারিত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে এবং কাজের মান বজায় রাখতে না পারলে হাওরের ফসল রক্ষা কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যাবে। যা কারো কাম্য নয়।
আমাদের সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ ও হাওরবাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা ক্রমবর্ধমান এই সংকট মোকাবিলায় সফল হতে পারে। তাই আসুন,আমরা সচেষ্ট হই। হাওরের ফসল রক্ষায় সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করি। ক্রমাগত অস্তিত্ত্বের হুমকিতে নিপতিত হতে চলা এই হাওর জনপদকে ঠিকিয়ে রাখতে ঐক্যবদ্ধ হই।#
রাসেল আহমদ
হাওরাঞ্চল ব্যুরো চীফ রিপোর্টার,বঙ্গ-নিউজ