ইউক্রেন যুদ্ধ
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদায়ি বছরটিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে শক্তিশালী করছে—অভিযোগ তুলে রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশটিকে আক্রমণ শুরু করে। এই যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হবে এ ধারণা ভুল প্রমাণ করে বছরের শেষ পর্যন্ত চলে এই যুদ্ধ। বছরের শেষ দিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার হুমকি দেন। বিশ্ব অর্থনীতি করোনায় সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এ যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে অনুন্নত ও উন্নয়ন দেশগুলোতে খাদ্যমূল্য বেড়ে যায়। কারণ ইউক্রেন বিশ্ব অন্যতম গম রপ্তানিকারক দেশ। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে খাদ্য রপ্তানি একদম বন্ধ হয়ে পড়েছিল। পরে তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া খাদ্যবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়।
চার্লসের ব্রিটিশ সিংহাসনে আরোহণ
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৮ সেপ্টেম্বর ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনে আসীন হন প্রিন্স চার্লস। তার নাম হয় রাজা তৃতীয় চার্লস। ফেব্রুয়ারিতে এলিজাবেথ সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর বা প্লাটিনাম জুবিলি উদ্যাপন করেন। ব্রিটিশ রাজন্যবর্গের মধ্যে তিনিই দীর্ঘ সময় সিংহাসনে ছিলেন। এর আগে এই রেকর্ড ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার (৬৩ বছর)। ব্রিটেনের রাজা বা রানি গ্রেট ব্রিটেন ছাড়াও কমনওয়েলথভুক্ত ১৪টি দেশের সরকার প্রধানের মর্যাদা ভোগ করেন। অন্যদিকে চার্লসকে সিংহাসনে বসার জন্য সবচেয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় (৭৩ বছর)। ২০২৩ সালের ৬ মে ওয়েস্ট মিনস্টর অ্যাবিতে নতুন রাজা চার্লস ও তার স্ত্রী ক্যামিলার আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে অভিষেক ঘটবে।
ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
চলতি বছর ১০ ও ২৪ এপ্রিল দুই দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এতে মেরি লিপেনকে হারিয়ে নিজের অবস্থান অক্ষুণ্ন্ন রাখেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ। আগের নির্বাচনেও ম্যাক্রঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উগ্র ডানপন্থি ন্যাশনাল র্যালি পার্টির লিপেন। ২০০২ সালে জ্যাক শিরাকের পর ম্যাক্রঁই দ্বিতীয় মেয়াদে নিজের পদ ধরে রাখেন। ম্যাক্রঁর দল পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন ধরে রাখতে পারলেও এবারের নির্বাচনে ডানপন্থিরা আগের চেয়ে ভালো করে। পার্লামেন্টে ডানপন্থিদের আসন সংখ্যা আট থেকে ৮৯ এ পৌঁছে। এর ফলে তারা এবার বেশ কিছু সাংবিধানিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। এটি আগামী দিনগুলোতে ম্যাক্রঁর জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়বে বলে ধারাণা করা হচ্ছে।
ব্রিটেনে এক বছরে তিন প্রধানমন্ত্রী
ব্রিটেনে চলতি বছর প্রধানমন্ত্রী দুুবার রদবদল ঘটেছে। বরিস জনসন ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপর এ পদে আসেন লিজ ট্রাস। তিনি খুব অল্প সময়ের জন্য ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছিলেন। ৪৪ দিন ঐ পদে থাকার পর ইস্তফা দিতে হয়। আসেন প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋশি সুনাক। মূলত অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যর্থতা এবং নিজের দল কনজারভেটিভ পার্টিতে আস্থা হারানোর পর ২০ অক্টোবর পদত্যাগ করেন ট্রাস। এরপর দলীয় ভোটে জিতে সরকারের হাল ধরেন সুনাক। তিনি মাত্র সাত বছর আগে এমপি হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি দুবছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার চলার পথটিও যথেষ্ট মসৃণ নয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ফিলিপাইনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
ফিলিপাইনের জনগণ যে একনায়ক ফার্ডিনান্ড মার্কোসকে এক সময় গণ-আন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল তারই ছেলে এ বছর দেশটিতে ক্ষমতার শীর্ষ পদে ফিরে এসেছেন। ৯ মে সেদেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ফার্ডিনান্ড মার্কোস জুনিয়র (বংবং মার্কোস) ও রেনি রোব্রেদোর। রোব্রেদো বিদায়ি প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুর্তেতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অনেকে মনে করে দুতের্তে মাদক নিয়ন্ত্রণে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করায় তার প্রতি জনগণের মন বিষিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া করোনার সময় তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন বলেও অভিযোগ আছে। তার প্রশাসনের চালানো অভিযানে কত লোক নিহত হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও পদক্ষেপ দাবি করেছিল।
হংকংয়ে প্রধান নির্বাহী নির্বাচন
হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী নির্বাচন স্বাভাবিকভাবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মনোযোগের বিষয়বস্তু না হলেও ৮ মে অনুষ্ঠিত ঐ নির্বাচনে মূলত দুটি কারণে সবার নজর ছিল। একটি হলো গণতন্ত্রপন্থিদের দীর্ঘ আন্দোলনের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া ঐ আন্দোলন যদিও পরের বছর করোনার থাবায় থিতিয়ে পড়েছিল কিন্তু তার রেশ এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। আরেকটি কারণ হলো স্বশাসিত অঞ্চলটি চীনের কাছে হস্তান্তরের ২৫ বছরের মাথায় এ নির্বাচন হয়। এ সময়ে সেখানে চীনের প্রভাব কতটা বেড়েছে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। নির্বাচনে চীনপন্থি সাবেক শীর্ষ নির্বাহী ক্যারি লামের স্থলাভিষিক্ত হন তারই নিরাপত্তা প্রধান জন লি। পারিবারিক কারণ দেখিয়ে লাম নির্বাচনে দাঁড়াননি, ফলে লি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
ইমরান খান আবারও রাজপথে
পাকিস্তানে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা হারালেও নতুন শক্তি সঞ্চয় করে রাজনীতির মাঠে ফেরেন তেহরিক ই ইনসাফ পাকিস্তানের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান। ৯ এপ্রিল তার কোয়ালিশনের পতন ঘটে। এরপর থেকে বলতে গেলে প্রায় পুরোটা বছর তিনি রাজনীতির মাঠ গরম রাখেন। ১১ এপ্রিল দেশটির পার্লামেন্টবিরোধী পিএমএল-এন নেতা শাহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসায়। ইমরান খান বছর জুড়ে কয়েকটি লংমার্চে নেতৃত্ব দেন। এসব লংমার্চে বিপুল জনসমাবেশ ঘটে। ৩ নভেম্বর পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে সমাবেশ চলাকালে তাকে হত্যার এক ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। এছাড়া দেশটির সেনাপ্রধান পদেও রদবদল ঘটে।
রাজাপক্ষে পরিবারের বিদায়
প্রবল গণ জোয়ারের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজপক্ষ দেশছাড়া হন জুলাইতে। ৯ জুলাই প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে সাধারণ জনতা ঢুকে পড়ার দৃশ্যগুলো সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তোলে। ১৪ জুলাই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। এর দুমাস আগে প্রধানমন্ত্রী (তার ভাই) মাহিন্দ রাজাপক্ষে বিক্ষোভের মুখে দেশত্যাগ করেন। তার দলের বহু এমপিও হেনস্তার শিকার হন। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের জেরে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশটিতে গণ বিক্ষোভ শুরু হয়। মাহিন্দ প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর বিক্রমাসিংয়ে ঐ পদে বসেন এবং পরে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। এসব কিছুর পরও পার্লামেন্টে রাজাপক্ষেপন্থিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে যায়। অর্থনৈতিক
সংকট থেকে বিক্ষোভের সূচনা। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিও ছিল এর আরেকটি কারণ।
আম আদমি পার্টির উত্থান
ভারতের দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরভিন্দ কেিরওয়ালের নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টি গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে পাঁচটি আসন পায়। বিজেপি যথারীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন ধরে রাখে। আপের পাঁচটি আসন পাওয়া বড় কোনো ঘটনা না হলেও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—এর আগে ২০১৭ সালে তারা পেয়েছিল ১ শতাংশ ভোট। সেটি বেড়ে ১৩ শতাংশ হয়। এর ফলে দলটি নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি জাতীয় দলের স্বীকৃতি পায়। নির্বাচনে তাদের অর্জন কংগ্রেসকে ছাপিয়ে যায়।কংগ্রেসের ভোট আগের ৪১ শতাংশ থেকে ২৭ শতাংশে নামে। দিল্লি পৌরসভা নির্বাচনেও ভালো ফল করে আপ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আপ বিজেপির ভোট ব্যাংকে ভাগ বসাতে না পারলেও কংগ্রেসের ভোট কমিয়ে দিয়েছে। এই ধারা চলতে থাকলে আপ দেশটির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারে।
শিনজো আবে হত্যা
জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো একটি রাজনৈতিক সমাবেশ চলাকালে চলতি বছর ৮ জুলাই নিহত হন। শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে পরিচিত জাপানে সেদেশেরই একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বিষয়টি সে কারণেই সবার মনোযোগ কাড়ে। বিশেষ করে এ ঘটনার পেছনে বড় কোনো রাজনৈতিক কারণ পাওয়া যায়নি। আবে জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অর্থনীতির প্রশ্নে তিনি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা ‘আবেনোমিক্স’ নামে পরিচিতি পায়। তার পিতামহ নবসুকে কিশিও দেশটির প্রধানমন্ত্রী। তাই রাজনীতিতে তার একটি পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল।