শ্যামা সঙ্গীতের রূপকথা
চারিদিকে মানুষ অবাক হয়ে তার গান শুনতেন। হালিশহরের নামজাদা পন্ডিত বলরাম তর্কভূষণ একদিন রামপ্রসাদ সেন কে দেখলেন টলমল পায়ে গঙ্গাস্নান করতে চলেছেন। তাই দেখে বলরাম পন্ডিত চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, দেখ দেখ মাতাল বেটা যাচ্ছে। সে কথা শুনে রামপ্রসাদ সেন হেসে হেসে গাইলেন তার বিখ্যাত গান-
”সূরা পান করিনে আমি
সুধা খাই জয় কালী বলে।
মন মাতালে মাতাল করে
মদ মাতালে মাতাল বলে।”। “
আবার তিনি যখন গান ধরেন-
”ডুব দেরে মন কালী বলে
হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে”।
তখনও সকলে স্থির হয়ে তার গান শুনতেন। কারও কিছু বলার জন্য কোন শক্তিই থাকেনা। সবাই যেন একদম মন্ত্রমুগ্ধ । রামপ্রসাদ সেনের গানকে বলা হয় রামপ্রসাদী গান। আসলে সার্বিক অর্থে এক নতুন ধারার গান। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যে মৃদুরাগ ,সেই মৃদৃ রাগের সাথে ভক্তি রসের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে রামপ্রসাদ সেন বাংলার সঙ্গীতে যে “মধুর” ,আটপৌরে ও অসংস্কৃত” নতুন সুর সৃষ্টি করে ছিলেন, পরবর্তী দেড়শ বছর ধরে শতাধিক কবি ও সঙ্গীতকার সেই সুর ধরেই গান রচনা করে ছিলেন। বলাবাহুল্য আজও শ্যামা সঙ্গীত রচনা ও পরিবেশনার ক্ষেত্রে তাকেই বহুলাংশে অনুসরণ করা হয়।
সত্যি কি আশ্চর্য সব গান লিখে গিয়েছেন তিনি। তার গান শুনে মুদ্ধ হয়ে স্থানীয় জমিদার তাকে দিয়ে ছিলেন ”কবি রঞ্জন “ উপাধি। সেই সময়ে রাজ কিশোর মুখোপাধ্যায় নামে এক ধনবান কালী ভক্তের বিশেষ অনুরোধে রামপ্রসাদ সেন লিখেছিলেন তার প্রথম পুঁথি “ কালী কির্তন”। এই কালী কীর্তন শেষ করে এর পর তিনি লিখলেন আরও দুটি ছোট ছোট পুঁথি। “কৃষ্ণ কীর্তন” ও “ সীতার বিলাপ”। সাধক কবি কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের খ্যাতি তখন দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে।
রামপ্রসাদের বাবা হলেন রামরাম প্রসাদ সেন। প্রথম স্ত্রী কাত্যায়নী সেন, আর দ্বিতীয় স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী দেবী । দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের জন্ম।
একদিন গঙ্গার বুকে তিনি গান ধরেছেন। আর সেই সময় গঙ্গায় নৌকাযোগে যাচ্ছিলেন নবদ্বীপের অধিপতি মহারাজ কৃষ্ণ চন্দ্র । রামপ্রসাদের সুললিত কন্ঠের গান শুনতে পেলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র । যতক্ষণ রামপ্রসাদের গান চললো ততোক্ষণ তিনি গঙ্গার বুকে নৌকা দাঁড় করিয়ে একান্ত মনে সে গান শুনলেন। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদ সেনের সাথে আলাপ করলেন। পরবর্তী সময়ে নবদ্বীপে ফিরেই মহারাজা খবর পাঠালেন যে, রামপ্রসাদ সেনকে তিনি তার সভা কবি করতে চান। কিন্তু মায়ের সাধনায় নিমগ্ন রামপ্রসাদ সেন বিনীত ভাবে সে চাকুরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বুঝলেন, রামপ্রসাদ সেন নির্লোভ এক সাধক। চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানে মহারাজা ক্রোধান্বিত হলেন না, বরং তার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেলো। তিনি তার সভাকবি ভারতচন্দ্রের মতো রামপ্রসাদ সেনকে বিদ্যাসুন্দর কাব্য লিখতে অনুরোধ করলেন। মহারাজার সেই অনুরোধ রামপ্রসাদ সেন অবশ্য উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি লিখেছিলেন তার অসাধারণ কাব্য- যা ছিল তার কাব্য প্রতিভার অনন্য এক উজ্বল দৃষ্টান্ত। কিংবদন্তী আছে যে, বাংলার নবাব সিরাজ উদদৌলা রামপ্রসাদ সেনের গান শুনে ছিলেন।
(চলবে)