কোলকাতায় ফিরলেন বটে, কিন্তু এখানে চারিদিকে ব্যঙ্গ বিদ্রোপ, নিন্দা আর সমালোচনায় একেবারে অতিষ্ট হয়ে পড়লেন তারা। বিরক্ত বিতশ্রদ্ধ অতুলপ্রসাদ সেন এবার কোলকাতা ছাড়লেন সপরিবার। সপরিবার তিনি তিনি চলে গেলেন লক্ষ্নৌ শহরে। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে, লক্ষ্নৌ শহরে তার পসার জমে উঠে ছিল। শহরের কেশরবাগ অঞ্চলে সে যুগের তেত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে রাজপ্রাসাদের মতো একটা বাড়ি তিনি তৈরি করে ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই বার কাউন্সিলের তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। অসাধারণ সব দেশাত্মবোধক গান, ভক্তি রসের গান, প্রেমের গান লিখে সুর দিয়ে বাংলা গানের মধ্যে হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূর্ছনা প্রবেশ করিয়ে নতুন বাংলা গানের ধারা তৈরি করে তিনি হয়ে উঠে ছিলেন শহরের বিদগ্ধজনের মাঝে শহরের অন্যতম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ সবই সত্য। কিন্তু আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হলেও সামাজিক ভাবে বিপুল প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও তিনি কোন মানসিক শান্তি বা স্থিরতা কখনোই অর্জন করতে পারেন নি। অপ্রত্যাশিত এক যন্ত্রনায় বিষাক্ত হয়ে উঠে ছিল তার জীবন। এর মুল কারনই ছিল ক্ষত বিক্ষত তার দাম্পত্য জীবন। সামাজিক পারিবারিক সমস্ত বাধাকে উপেক্ষা করে তিনি যাকে বিয়ে করেছিলেন, সেই হেমকুসুমের সাথে সুখের সাংসারিক জীবন যাপন তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই অশান্তির মূল কেন্দ্রে ছিলেন কিন্তু হেমশশী দেবী। অতুলপ্রসাদ সেনের মা। মায়ের দ্বিতীয় স্বামী দুর্গামোহন দাসের মৃত্যু হলে অতুলপ্রসাদ সেন তার মাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে ছিলেন লক্ষ্নৌয়ে। আর তখন থেকেই ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠেছিল সাংসারিক অশান্তির লেলিহান শিখা। হেমকুসুম ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। বিয়েকে কেন্দ্র করে আত্মীয় স্বজনদের যে আচরণ , বিশেষ করে শ্বাশুড়ী হেমশশী দেবীর যে শক্ত বাধা তিরষ্কার , সমালোচনা , তা কখনোই তিনি ভুলতে পারেন নি। এমন শ্বাশুড়ীর সঙ্গে কোন রকম সম্পর্ক রাখতে তিনি রাজি ছিলেন না। ফলে অচিরেই শুরু হয়েছিল শ্বাশুড়ী –পুত্রবধূর ভয়ংকর সংঘাত। বলাবাহুল্য অতুলপ্রসাদ সেন সেই সংঘাতের কোন কূলকিনারা করতে পারেন নি। মাকে যেমন তিনি শান্ত করতে পারেনি , তেমনি স্ত্রীকেও সংযত করতে পারেন নি। মাঝখান থেকে তিনি বারবার হয়েছিলেন যন্ত্রণাবিদ্ধ। গভীর ভাবে বেদনাবিদ্ধ। হেমশশী দেবীর মৃত্যুর পর ঘরে তার ফটো টাঙ্গানো ছিল। তা সরিয়ে ফেলার দাবি তুলেন হেমকুসুম। কিন্তু মায়ের ছবিকে এ ভাবে অসম্মান করতে নারাজ অতুলপ্রসাদ সেন। এবার হেমকুসুম চিরকালের জন্য স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। হেমকুসুম অবশেষে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে লক্ষ্নৌ শহরে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে লাগলেন। একই শহরে তারা রয়েছেন, কিন্তু আলাদা আলাদা বাড়িতে। সে এক দুঃসহ বিচ্ছেদের জীবন। অথচ তাদের মধ্যে কিন্তু ছিল ভালবাসার পূর্ণপাত্র। এমনও হয়েছে ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বাসর বা গানের আসর। স্ত্রী হেমকুসুম এসে সমস্ত আয়োজন করেছেন হাসিমুখে। নিজের হাতে। আবার অনুষ্ঠান শেষে তিনি ফিরে গেছেন তার সেই ভাড়া বাড়িতেই। আবার কখনও স্বামী অসুস্থ হয়েছেন, স্ত্রী ছুটে এসেছেন । শুশ্রূষা করেছেন। আবার স্ত্রী অসুস্থ হয়েছেন, স্বামী ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু সে সবই ছিল সাময়িক। আসলে দাম্পত্য জীবনের যে সম্পর্কে চির ধরেছিল তা আর কখনই জোড়া লাগেনি। বিচ্ছেদের সেই সুদীর্ঘকালে স্ত্রী হেমকুসুমের কন্ঠে কিন্তু ঠাঁই পেতো স্বামী অতুলপ্রসাদ সেনেরই গান। আর স্বামী, তিনিও স্ত্রীর বিরহে বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন চোখের জলে, গান লিখে, গান গেয়ে, অথবা গানে সুর দিয়ে। মনে পড়ে তার সেই বিখ্যাত গানটির কথা-
” বধূয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে,আমিও একাকী,তুমিও একাকী, আজি বাদল রাতে।
জীবনের অপরাহ্নে ক্ষতবিক্ষত দাম্পত্যের যন্ত্রণায় অতুলপ্রসাদ সেনের জীবনী শক্তির ক্ষয় হয়েছিল। একেবারে শেষের দিকে অসুস্থ শরীরে তিনি হাওয়া বদলের জন্য পুরী গিয়ে ছিলেন। পুরী থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরলেও আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। লক্ষ্নৌয়ের বাড়িতে একে একে সবাই তাকে দেখতে আসলেন। কিন্তু স্ত্রী হেমকুসুম তিনি আসলেন না। অবশেষে সমস্ত অভিমান ভুলে হেমকুসুম যখন আসলেন , তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। তখন এই পৃথিবীতে তিনি আর নেই । পড়েছিল তার নিষ্প্রাণ নিথর দেহ। ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট লক্ষ্নৌয়ে ৬৩ বছর বয়সে অতুলপ্রসাদ সেন গভীর রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তার মৃত্যুর সাথে তার দীর্ঘ দুঃখ যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটলো। যে দুঃখ , যে যন্ত্রণা তাকে সৃষ্টির পথে চালিত করেছিল আজীবন।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন কাওরাইদ ব্রহ্ম মন্দিরের পাশে সমাধিস্থলে তার চিতাভষ্ম সমাহিত করা হয়। এখানে একটি স্মৃতি ফলকে লেখা আছে “ মোদের গরব মোদের আশা ,আ – মরি বাংলা ভাষা। তোমার কোলে তোমার বোলে , কতই শান্তি ভালোবাসা “।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় তখনকার স্মৃতি ফলকটি পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করে ভেঙ্গে দেয়। পরে নতুন করে তা আবার তৈরি করা হয়। নতুন স্মৃতি ফলকে লেখা রয়েছে-
-অতুলপ্রসাদ সেন, জন্ম-১৮৭১, ২০ অক্টোবর। মৃত্যু- ১৯৩৪ ,২৭ আগস্ট।
“ শেষে ফিরব যখন সন্ধ্যা বেলা
সাঙ্গ করে ভবের খেলা
জননী হয়ে তখন কোল বাড়ায়ে রবে
আমার যে শূন্য ডালা ,তুমি ভরিয়ো
আর তুমি যে শিব, তাহা বুঝিয়ে দিয়ো ।”
তথ্যঋণ-
১। প্রিয়জনের প্রিয়তমা-পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
২। আজীবন বিষাদ-বেদনায় তার গানের আধার- কৃষ্ণা রায় (প্রবন্ধ )
৩। আমিও একাকী তুমিও একাকী-
৪। অক্লান্ত কন্ঠ এক সঙ্গীত সন্যাসী তিনি ( প্রবন্ধ )
৫। কেচ্ছা – সুস্নাত চৌধুরী ( প্রবন্ধ )
৬। আনন্দ বাজার পত্রিকা।
৭। উইকিপিডিয়া ।