তার গানগুলি মূলত স্বদেশী সঙ্গীত, ভক্তিগীতি, ও প্রেমের গান- এই তিন ধারায় বিভক্ত। তবে তার ব্যক্তি জীবনের বেদনা সকল ধরনের গানেই কম-বেশী প্রভাব ফেলেছে। তার অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুন রস প্রধান। বাংলা সাহিত্যে অতুলপ্রসাদ সেনই প্রথম ঠুংরির চাল সংযোজন করেন। উল্লেখ করা যায় যে, বাংলা ঠুংরি গীতিধারার প্রথম প্রচলন করেন লক্ষ্নৌয়ের বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ। আর অতুলপ্রসাদের বিশেষত্ব এই যে, তিনি বাংলা গানের সুর-তালের বৈশিষ্ট অক্ষুন্ন রেখেই হিন্দুস্থানি রীতির প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। অতুলপ্রসাদ সেন জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় উত্তর ভারতে কাটিয়ে ছিলেন। সে জন্য ওখানকার সাঙ্গীতিক পরিমন্ডলের সাথে মিশে গিয়ে তিনি হিন্দুস্তানি গীতি পদ্ধতিকে রপ্ত করতে সমর্থ হন। তাই বাংলা গানে হিন্দুস্তানি ঢঙ্গের মিশ্রণ ঘটানো তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ছিল। অতুলপ্রসাদ সেনের এই প্রয়াস বাংলা গানের একদিকে যেমন নতুনত্ব এনেছে, অপর দিকে তেমনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ উন্মুক্ত করে বাংলা গানের জগতকে এক বন্ধনমুক্ত শৈল্পিক আবহ নির্মাণে সক্ষম হয়েছে। হিন্দুস্তানি লঘু ,খেয়াল, ঠুংরি, ও দাদরা সঙ্গীতের সুষমা মন্ডিত সুরের সঙ্গে তারে ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে ছিল।
হিন্দুস্তানি সুর সংযোজনায় বাংলা গানের কাব্যিক মর্যাদা কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছে বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করলেও একটি স্বতঃস্ফুর্ত সাঙ্গীতিক ভাব তার প্রায় সকল গানে পরিলক্ষিত হয়। যেখানে সুর সঙ্গীতের মাধুর্য নিয়ে কথার ভাবকে ছাড়িয়ে গিয়েছে সেখানেই অতুলপ্রসাদের সার্থকতা। তার ঠুংরি ও দাদরা ভঙ্গিয় গানগুলি শৈল্পিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। এমন কয়েকটি গানের মধ্যে রয়েছে – “ কি আর চাহিব বলো (ভৈরবী/ টপ খেয়াল) , ওগো নিঠুর দরদী ( মিশ্র আশাবরি-দাদরা ) , যাবনা যাবনা ঘরে (ঠুংরি ) ইত্যাদি।
তিনি রাগ প্রধান ঢঙে বাংলা গানে যে সুর সংযোজন শুরু করেন, তা পরবর্তী কালে একটি শক্তিশালি ধারা হিসেবে বিকশিত হয়। কাজী নজরুল ইসলামের গান এবং রাগ প্রধান অঙ্গের অন্যান্য আধুনিক গান এ ভাবে একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে গড়ে উঠে।
অতুলপ্রসাদ সেন তাঁর জীবনে প্রথম আঘাতটি পান পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। মায়ের নাম ছিল হেমন্তশশী দেবী। প্রথম স্বামী রামপ্রসাদ সেন, যিনি ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেনের বাবা। তার অকাল মৃত্যুর পর হেমন্তশশী দেবী ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকতেন। একদিন ছেলেমেয়েদেরকে বাপের বাড়ি রেখে কিছু সময়ের জন্য তিনি বড় ভাই কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তের কাছে যান। সেই যে গেলেন আর এলেন না। কিছুদিন পর খবরে জানাজানি হলো যে, তেতাল্লিশ বছর বয়ষ্ক বিধবা হেমন্তশশী দেবী ,যিনি চার ছেলেমেয়ের মা তিনি বিয়ে করেছেন ঊনপঞ্চাশ বছর বয়েসী ব্রাহ্ম নেতা দুর্গামোহন দাসকে, যিনি আবার ছয় সন্তানের বাবা। বিয়েটা হয়েছিল অত্যন্ত গোপনে। কিন্তু তা সত্বেও সমাজে , চারিদিকে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেলো। অতুলপ্রসাদ সেন গভীর আঘাত পেয়েছিলেন তাতে। তীব্র যন্ত্রণায়, ভীষণ অভিমানে মায়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন তিনি। সত্যি বলতে কি যৌবনের প্রারম্ভে তিনি মায়ের কাছ থেকে যে আঘাত পেয়েছিলেন তা সারা জীবনেও ভুলতে পারেন নি। ১৮৯৫ সালে বিলেত থেকে ফিরলেন ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ সেন। বিলেতেই বড় মামার মেয়ে হেমকুসুমের সাথে তাঁর তৈরী হয়েছিল প্রগাঢ় ঘনিষ্টতা। মনের গভীরে এক স্বপ্ন নিয়ে কোলকাতার সার্কুলার রোডে বাড়ি ভাড়া করে উকালতি করবেন তার জন্য অফিস খুললেন। একদিন ভূমিকা না করে বাড়িতে আচমকা ঘোষণা করলেন, তিনি হেমকুসুমকে বিয়ে করবেন। আত্মীয় পরিজন, পাড়াপ্রতিবেশী , মা, সৎ বাবা,সবাই শুনে শিউড়ে উঠলেন। হিন্দু সমাজে যে এটা একেবারেই নিষিদ্ধ। নিজের রক্তের সম্পর্ক। এটা কেহই মানতে পারছিলেন না। মামাতু পিসতুত ভাইবোন- এ বিয়ে হয় কি করে? এ যে ঘোর অনাচার। বাধার শক্ত প্রাচীর তৈরি করলেন অতুলপ্রসাদ সেনের মা হেমন্তশশী দেবী। শুনা যায় অতুলপ্রসাদ সেনের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে মার প্রতি প্রতিশোধস্পৃহা নাকি কাজ করেছিল। যাই হোক, বিয়ের ব্যাপারে একদিকে অতুলপ্রসাদ সেন যেমন ছিলেন নাছোড়বান্দা, তেমনি অন্য দিকে মামাতো বোন হেমকুসুমও ছিলেন পৃথিবীর যে কোন বাধাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। এতো বছর ধরে দু’টি মনের মধ্যে প্রেমের যে ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়েছে,তার স্বীকৃতি চাইছে সরবে। কিন্তু কে দেবে এই বিসম প্রেমের স্বীকৃতি ? পারিবারিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে তো শুধু বাধা নয়, বাধা তো আইনেও। ব্রিটিশ বা হিন্দু আইনে এ দেশে এই বিয়ে কখনোই সিদ্ধ নয়। তা হলে উপায় ? দিশে হারা উদ্ভ্রান্ত অতুলপ্রসাদ সেনকে অবশেষে আশার আলো দেখালেন তারই সিনিয়র সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন , স্কটল্যান্ডে যেতে, । সেখানকার আইনে ভাই-বোনের বিয়ে আইন বিরুদ্ধ ছিল না। অতুলপ্রসাদ সেন আবার বিলেত যাত্রা করলেন। এবার সঙ্গে ছিল হেমকুসুম দেবী। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে স্কটল্যান্ডের গ্রেট নাগরিন গ্রামে তাদের বিবাহ পর্ব সাঙ্গ হয়। বিয়ের পর তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন যে, তারা আর দেশে কখনও ফিরবেন না। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। লন্ডন শহরে অতুলপ্রসাদ সেনের প্র্যাকটিস চললো না। এই ব্যবসার তেমন প্রসার ঘটাতে পারেননি তিনি। ফলে অর্থ সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। এরই মধ্যে ১৯০২ সালে যমজ দুই ছেলে দিলীপকুমার ও নিলীপ কুমারের মধ্যে নিলীপ কুমারের মৃত্যু ঘটলো। ছেলের মৃত্যুতে অতুলপ্রসাদ সেন একদম ভেঙ্গে পড়লেন। অবশেষে একদম বিধ্বস্ত অবস্থায় সপরিবার কোলকাতায় ফিরলেন অতুলপ্রসাদ সেন।
( চলবে)