সাহিত্য সমাজের আয়না। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির নৈতিক ভিত্তির উপরই একটি জাতির সামগ্রিক অস্তিত্ব নির্ভর করে। সভ্যতা-সংস্কৃতিতে যে জাতি যত মার্জিত, সে জাতি ততটা উন্নত ও মানবিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। কোনো জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, উত্থান-পতন সাহিত্যের মাধ্যমেই জীবন্ত হয়ে থাকে। সাহিত্যের মাধ্যমেই মানুষের জীবন পরিশীলিত ও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং মানবিক বোধের বিকাশ ঘটিয়ে সৃজনশীলতায় উদ্বুদ্ধ করার একটি মহান প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু হয় পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের। আজ থেকে বাইশটি বছর পূর্বে এ প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক পদচারণা ঘটে সাহিত্যাঙ্গনে। এ দীর্ঘ সময়ের যাত্রায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশন সৃষ্টি করেছে অসংখ্য লেখক-গবেষক এবং সাহিত্যমোদী। যাদের চিন্তাচেতনায় মানবকল্যাণ যেন ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছে প্রতিনিয়ত।
নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রচার, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং বিশ্বাসী ধ্যান-ধারণাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে বিশিষ্ট লেখক, প্রকাশক ও সংগঠক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সলের হাত ধরে যাত্রা হয় পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ প্রতিষ্ঠান যেমন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে দ্যোতি ছড়িয়ে যাচ্ছে, তেমনই সমগ্র বিশ্বের আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেছে পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের ঐশ্বরিক আহবান। এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল অত্যন্ত ধীমান ও কর্মমুখর সাহিত্যসুধী। তাঁর মননচিন্তা, গদ্য, সৃজনশীলতা খুবই শানিত। অগ্রসর ভাবনা ও আদর্শিক চেতনার নৈপুণ্যে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ। বিবিধ পরিচয়ের ভেতরে লেখক, প্রকাশক ও সংগঠক হিসেবে তিনি এখন দেশে-বিদেশে বেশ সমাদৃত। সৃজন প্রচেষ্টায় তাঁর রচনাকর্ম এখন প্রশংসাপ্রাপ্য। সত্যনিষ্ঠা ও স্পষ্টবাদী গুণাবলির কারণে সুধীসমাজে গ্রহণযোগ্য অবস্থান করে নিয়েছেন তিনি। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশনা শিল্পে কেবল গ্রন্থপ্রকাশই নয়, গ্রন্থ নির্মাণের সাফল্যও অর্জন করেছেন। সাহিত্য, সম্পাদনা ও প্রকাশনা জগতে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি অনস্বীকার্য।
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ অঞ্চল গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের নালিউরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এককালে সার্বক্ষণিকভাবে সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা এবং বিকাশের মনোভাবনা নিয়েই তাঁর প্রকাশনা অঙ্গনে শুভাগমন ঘটে। তিনি নিজেও একজন লেখক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। সামগ্রিক ভাবনার উচ্চতর চিন্তা এবং আদর্শিকতা তাঁর নৈতিক ভিত্তিকে করেছে আদরণীয়। এ পর্যন্ত তাঁর সাতটি মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থগুলো হচ্ছে–মানুষের অনন্ত জীবন (২০১০), শিলচর ভ্রমণের আনন্দস্মৃতি (২০১৩), সিয়াম সাধনার ফজিলত (২০১৩), মুসলিম জীবনে বিয়ে ও দাম্পত্য (২০১৪), পার্থিবজীবনে লোভের পরিণতি (২০১৪), মনের মুকুরে দাগকাটা মুখ (২০১৮), বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা (২০১৯) ও সফলতার থ্রি ডাইমেনশন (২০২০) প্রভৃতি। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো পাঠক সমাজে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। সম্পাদনায়ও তিনি রেখেছেন স্বকীয়তার ছাপ। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে—বাংলাসাহিত্যের প্রাচীন উপন্যাস আর্জুমন্দ আলী রচিত ‘প্রেমদর্পণ’ (২০০৮), আবদুল মালিক চৌধুরীর ‘পরদেশী’ (২০০৮) ও নূতন ইমাম (২০১১), স্মারকগ্রন্থ সময়ের আলোয় হারূন আকবর (২০১৩)। অনুবাদের ক্ষেত্রেও তিনি নিজস্ব মেধা, প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতার প্রচ্ছন্ন ছায়া রেখেছেন। ‘প্রত্যেক মুসলিমের যেসব বিষয় জানা ওয়াজিব (২০১১), আপনার ঈমান কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য (২০১১), হাদিস বর্ণনাকারী একশত সাহাবী এবং বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ (২০১১), কুরআন সুন্নাহর আলোকে আন্তরিক তওবা (২০১৩) প্রভৃতি। এছাড়া যৌথ সম্পাদনা এবং মননশীল ছোট কাগজ ‘পাণ্ডুলিপি’ও তাঁর মননচিন্তার উজ্জ্বল স্মারক।
লেখক, প্রকাশক ও সংগঠক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সলের কর্মপরিধি সুদূরপ্রসারী চিন্তার পরিচায়ক। তিনি বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত আছেন। তিনি গোলাপগঞ্জ ফাউন্ডেশনের সভাপতি, ইন্দো-বাংলা মৈত্রীর বাংলাদেশ শাখার সম্পাদক, হলিসিটি ট্যুরিস্ট ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের জীবনসদস্য। তিনি একসময় গান ও নাট্যচর্চা করতেন। তার প্রকাশিত গানের অ্যালবাম আলোর পথে ডাক দিয়ে যায় (যৌথ ১৯৯৯) ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে একজন সংগঠক হিসেবে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘রোটার্যাক্ট ক্লাব অব সিলেট হলিল্যান্ড’ কর্তৃক ২০০৯-২০১০ রোটাবর্ষে সম্মাননা লাভ করেন। এছাড়া তিনি আসাম বিশ্ববিদ্যালয় শিলচরের আমন্ত্রণে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনদিন ব্যাপী ‘স্বাধীনতাপূর্ব শ্রীহট্টের পাণ্ডুলিপি ও পাণ্ডুলিপি বিশারদগণ : গুরুত্ব ও সার্বিকতা’ শীর্ষক সেমিনারে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে স্মারক সম্মাননা লাভ করেন। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র তাঁকে প্রকাশনা ও সম্পাদনায় বিশেষ অবদানের জন্য সম্মাননা স্মারক প্রদান করে। ‘সাউথ আসাম মিডিয়া এসোসিয়েশন’ তার হাতে এ সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়। এছাড়া আসামের কাছাড় থেকে বাংলাদেশ মননশীল লেখক-প্রকাশক হিসেবে ‘হাজি এস ইউ লস্কর এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন’ তাকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করে। তাঁর সামগ্রিক জীবনে ব্যক্তিমানসের প্রচ্ছন্ন ছায়ায় তিনি সিক্ত হয়েছেন। তিনি দেশ-বিদেশের অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির সঙ্গলাভ করেছেন। তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। নিজেও জ্ঞান আহরণ করেছেন এবং নানাভাবে সম্মানের অধিকারীও হয়েছেন। তাঁর জ্ঞান-গবেষণা এবং প্রাগ্রসর চিন্তা একটি আলোকময় সমাজ গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছে। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তার একটি কার্যকর সাফল্য।
লেখক, প্রকাশক ও সংগঠক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সলের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এখন একটি বিশাল মহীরুহ। পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের হাত ধরেই জন্ম হয়েছে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক এবং লেখকের। যাদের চিন্তা-চেতনা এবং সামগ্রিকতা একটি আদর্শিক ও মূল্যবোধীয় সমাজ নির্মাণের রূপরেখা নিয়ে কাজ করছে। পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের এ দীর্ঘ যাত্রায় যুক্ত হয়েছে অসংখ্য সাফল্যের সোনালি পালক। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন তাঁর প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজারেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। যা সিলেটের প্রকাশনা শিল্পে একমাত্র মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বিশ্বময় কুরআনের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রকাশ করেছে সহজ-সরল বাংলা তরজমা ‘আল কুরআনুল কারিম’। যুক্তরাজ্যের প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন শায়খ এইচএম শফিকুর রহমান আল মাদানী কর্তৃক অনূদিত এ সহজ-সরল তরজমাগ্রন্থ বারো হাজারেরও বেশি কপি প্রকাশ করা হয়েছে। যা দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাংলাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রকাশ করা হয়েছে আরবজাহানের নন্দিত আলেমে দ্বীন শায়খ ড. সাঈদ ইবনে ওয়াহহাফ আল কাহতানী রচিত ‘আল হিসনুল মুসলিম’ নামক দোয়াগ্রন্থটি। এ গ্রন্থের কয়েক হাজার কপি ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ইসলামপ্রিয় মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। আল কুরআনের নির্ধারিত সুরা নিয়ে প্রকাশকৃত ‘ওজিফা’ গ্রন্থটিও বেশ সমাদর এবং পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে।
পাণ্ডুলিপি প্রকাশন-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ গঠন করা। এজন্য পাণ্ডুলিপি প্রকাশন ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং শেকড়কে তুলে আনতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ‘ঐতিহ্য-সন্ধানে দৃঢ়কল্প’ স্লোগানকে ধারণ করে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন ‘প্রবন্ধ, বিজ্ঞান বিষয়ক, গবেষণা, স্মৃতিকথা, জীবনী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, ভ্রমণকাহিনি, অনুবাদ, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, নাটক, রম্য, রহস্য থ্রিলার, ছড়া-কবিতা, গল্প, শিশুতোষ, স্মারক/ম্যাগাজিনসহ বহুমুখী গ্রন্থ প্রকাশ করে আসছে। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন বাংলা, ইংরেজি, আরবি, নাগরীসহ বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। বাইশ বছরের এই দীর্ঘ যাত্রায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের গ্রন্থ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। এই গ্রন্থগুলো এক একটি সোনালি ইতিহাসের ধারক এবং বাহক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার এবং আলেম উলামাসহ সব মিলিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তির গ্রন্থ প্রকাশে স্বতন্ত্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
সিলেটের প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাস লিখতে হলে পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের ইতিহাসকে পাশ কেটে যাওয়া যাবে না। বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যগ্রন্থ প্রকাশে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন যে নতুন মাত্রা দেখিয়েছে, তা সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে নতুন করে উচ্চারিত হবে। একটি আদর্শিক অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন প্রকাশ করে যাচ্ছে সত্যের অমোঘ বাণী। আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, ত্যাগ-তিতীক্ষা এবং দায়বদ্ধতার সমন্বয়ে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে অনেক আগেই। সিলেটের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনকে আলোকায়নে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন যে ভূমিকা রাখছে, তা সময়ের পর সময় ধরে আলোচিত হবে নিঃসন্দেহে। আর আলোকিত সমাজ গঠনের যে অভিপ্রায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশন ধারণ করছে, তার গতিবিধিও চলবে নিরন্তর। আলোকিত পথেই তো পাণ্ডুলিপির পথচলা।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক