বাংলাদেশের নারী ফুটবলে এটা একটা জাগরণ। শুধু ফুটবলেই নয়, খেলাধুলায় মেয়েদের ব্যারিয়ার ভেঙে যাবে এই সাফল্যে। এখন বাবা-মা মেয়েদের ফুটবল খেলতে নিয়ে যাবেন। আমাদের অধিনায়ক সাবিনা, তৃষ্ণা, মার্জিয়া, মনিকা, আঁখি খাতুন একেকজন ব্র্যান্ড হবে। তাদের সারাজীবন মানুষ মনে রাখবে। মুখে মুখে নামগুলো থাকবে। প্রথমবারের মতো সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় অভিনন্দন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে।
এটা অত্যন্ত আনন্দঘন একটা মুহূর্ত। বাংলাদেশের জন্য ইতিহাস। এই ইতিহাস রচনায় খেলোয়াড়, কোচ, ট্রেনার সবার জন্যই বড় একটা পরিবর্তন সূচিত হলো। আমাদের এত দিন ফুটবল নেশন হিসেবে গণ্য করা হতো না। আমার বিশ্বাস, এখন করবে। এটা যে কতটা এগিয়ে যাওয়া- তা এককথায় বোঝানো যাবে না। ছোট্ট করে বললে, এটি নারী ফুটবলের জাগরণ।
এই মেয়েগুলো বছরের পর বছর চেষ্টা, পরিশ্রম, মেধা দিয়ে তিল তিল করে নিজেদের গড়ে তুলেছে। অনেক পরিশ্রম ও ত্যাগের ফসল আজ দেখতে পেলাম। তবে এটাই যেন শেষ না হয়। এটা একটা শুরু।
খেলোয়াড়রা যদি নিজেদের ধরে রাখতে পারে, তাহলে আরও অনেক সাফল্য ধরা দেবে। দেশে তৈরি হবে নারী ফুটবলের জাগরণ। আমার বিশ্বাস, আজকের এই রেজাল্ট দেশের প্রত্যেক মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। মেয়েদের ফুটবল খেলার অনুপ্রেরণার জায়গাটা এলো। বলার মতো কিছু হলো যে ফুটবল খেলেও বড় হওয়া যায়। কী হবে খেলে- এটা কেউ বলবে না। মেয়েরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। সরকার বাহবা দেবে। মানুষ তাদের সম্মান করবে। একটা মেয়ে হিসেবে আর কী চাই! যেখানে আমাদের পড়ালেখাই করতে দিতে চায় না, সেখানে এই মেয়েগুলোকে রাষ্ট্র চ্যাম্পিয়নের সম্মান দেবে। এই স্বীকৃতি বিশাল প্রাপ্তি।
অনেক সংগ্রাম করে মেয়েদের এই পর্যায়ে আসা। যারা প্রথমে শুরু করেছে, তারা ব্যারিয়ার ভেঙেছে। বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে নারী ফুটবলের প্রসার ঘটেছে। সরকারের তরফ থেকে এটা করা না হলে এই রেজাল্টটা পেতাম না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে মেয়েদের ফুটবলকে সর্বজনীন না করলে এতগুলো প্রতিভাবান ফুটবলার তৈরি হতো না। ছেলেদের ফুটবলসহ অন্য খেলাগুলোতে সাফল্য পেতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে খেলাধুলাকে সর্বজনীন করতে হবে। যে মেয়েগুলো আজ থেকে পাঁচ বছর আগে অনূর্ধ্ব-১৬ খেলেছে, সেই মেয়েগুলোই আজ সাফের ফাইনাল খেলেছে। জাতীয় দলে মেয়েগুলোর বয়স ২৪-২৫। একসঙ্গে খেলতে খেলতে মেয়েগুলো ফুটবলের সঙ্গে অটো হয়ে গেছে। একই ট্রেনিং পেয়েছে, একই খাবার খেয়েছে, একই ছাদের নিচে থেকেছে, নিজেদের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে- যেটা ফুটবলে অটোমেটিক করেছে মেয়েদের। তাদের শারীরিক ভাষা ফুটবলের ভাষা। প্রত্যেকের পেশি ফুটবলের পেশি। আমরা যখন খেলেছি, তখন এভাবে বিকাশ হয়নি। ফুটবল মাসল মেমোরি নিয়ে সাবিনারা খেলছে। তাদের নিউরোসিগন্যাল অটোমেটিক রেসপন্স করছে কীভাবে খেলতে হবে। এককথায় দুর্দান্ত খেলেছে। পেশাদার ফুটবল যেভাবে খেলে, সেটাই খেলেছে তারা। নেপালে মাঠে বসে আমি খেলা দেখেছি, সেখানে স্কিল ও গতি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। টিভিতে দেখে যেটা বোঝা যাবে না। টিভিতে কিছুটা খেলা দেখি, দর্শক দেখি, রেফারি দেখি। কিন্তু মাঠে বসে দেখলে আসল খেলাটা উপভোগ করা যায়। তারা কতটা উন্নতি করেছে, তা দেখেছি কাঠমান্ডুতে। সত্যিই অসম্ভব উন্নতি করেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। জয়তু নারী ফুটবল দল। জয়তু বাংলাদেশ।
লেখক :সাবেক ফুটবলার ও বর্তমানে আন্তর্জাতিক নারী রেফারি।
সূত্রঃ সমকাল