স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো শহরে গিয়ে যে বক্তৃতা দিয়ে ছিলেন আজ তার ১২৯ বছর পূর্ণ হলো। আজ ১১ই সেপ্টেম্বর। ১৮৯৩ সালের এই দিনে তিনি শিকাগো শহরে সর্ব ধর্ম মহা সভায় এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। আজকের দিনে কৌতুহল বসত ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে সেই ভ্রমণ কাহিনী জেনে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলাম। রীতিমত সব নাটকীয় ঘটনা। যা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়। তবে আমি যতসব তথ্য-উপাত্ব গ্রহন করেছি, তা একান্তই ঐসব সূত্রগুলোর উপর নির্ভর করে।
১৮৯০ সালের জুলাই মাসে স্বামীজী ভারত বর্ষের পথে পরিব্রাজক হয়ে শেষ বারের মতো বেড়িয়ে পড়লেন। তাঁর এই ভারত পরিক্রমার সময়ে বিদেশ থেকে খবর আসলো যে, আমেরিকার শিকাগো শহরে এই প্রথম আন্তর্জাতিক ধর্ম মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ভারত বর্ষের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, বহু কৃতি ব্যক্তি স্বামীজীর পান্ডিত্যে , স্বামীজীর প্রতিভায় তারা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তারা স্বামীজীকে শিকাগোর ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদানের জন্য অনুরোধ করলেন। শিকাগোর ধর্ম মহাসম্মেলন আসলে হয়ে উঠেছিল একটা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। স্বামীজী সেটিই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি তখন কন্যাকুমারী পরিভ্রমণ করে মাদ্রাজ এসে মনস্থির করলেন যে, তিনি শিকাগোতে যোগদান করবেন। কিন্তু এ বিষয়ে এগিয়ে যাবার জন্য তিনি মনে প্রাণে চাইছিলেন যে, মা-সারদা দেবী তাঁকে সম্মতি দেবেন। । অবশেষে সেই সম্মতি সূচক চিঠি পাওয়ার পর তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। আর সেই ঘোষণার সাথে সাথে তাঁর ভক্ত-শিষ্যরা তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা পূর্ণ উদ্দ্যমে নেমে পড়লেন স্বামীজীর পাশ্চাত্য যাত্রার আয়োজন করতে। লোক জনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁর জন্য সাহায্য চাইলেন। শুনে অবাক হবেন যে, সেই ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বণ করে তদানীন্তন প্রায় চার হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়ে ছিল। সেই টাকা দিয়ে স্বামীজীর জাহাজ যাত্রার জন্য একটা দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। টিকিট কাটার পর যে টাকা অবশিষ্ট রইলো তা স্বামীজীর হাতে হাত খরচের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য ক্ষেত্রীর রাজা অজিত সিং স্বামীজীর জাহাজ যাত্রার দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট টিকে প্রথম শ্রেণির টিকিটে পরিবর্তন করে দিলেন। একটা স্বপ্ন নিয়ে একটা মিশন নিয়ে স্বামীজী ১৮৯৩ সালের ৩১ শে মে এস এস পেনিং সোলার নামের একটি জাহাজে চেপে বোম্বে থেকে আমেরিকায় যাত্রা শুরু করলেন। প্রথমে কলম্বো , কলম্বো থেকে সিংগাপুর, সেখান থেকে হংকং এবং হংকং থেকে জাপান হয়ে তিনি পৌঁছালেন কানাডার ভেঙ্কুবার বন্দরে । যে দিন তিনি ভেঙ্কুবার বন্দরে পৌঁছালেন, তার পরের দিন সকালে কানাডার প্যাসিফিক রেলপথের বিখ্যাত রকি পর্বতমালা ভেদ করে তিনি শিকাগো শহরের দিকে রওয়ানা দিলেন। অবশেষে প্রায় দু;মাস জাহাজ যাত্রার পর ৩০শে জুলাই রবিবার রাত ১১ টার সময় শিকাগো শহরে উপস্থিত হলেন স্বামীজী। সম্পূর্ণ অপরিচিত, বন্ধু-বান্ধব হীন এক শীতার্থ পরিবেশের মুখোমুখি এই প্রথম ভারত বর্ষের এক সন্ন্যাসী। সেখানকার পরিবেশটাই ছিল সম্পূর্ণ তাঁর প্রতিকূলে। সেখানে প্রথমেই যে মর্মান্তিক সংবাদটি তিনি পেলেন , সেটি হলো এই যে, শিকাগো ধর্ম মহাসভায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার সময় ইতিমধ্যেই পার হয়ে গেছে। তাছাড়া শিকাগো ধর্ম মহাসভার কর্তা ব্যক্তিরা তাঁকে জানান যে, কোন স্বীকৃত সংগঠন বা কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির রিকমেন্ডেশন লেটার বা সুপারিশ পত্র ছাড়া কাউকে ধর্ম মহাসভার ডেলিগেট বা প্রতিনিধি করা হবে না। বলাবাহুল্য , স্বামীজীর কাছে তেমন কোন চিঠিপত্রের কিছুই ছিল না। প্রায় দু;মাস আগে যে স্বপ্ন নিয়ে স্বামীজী শিকাগো শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে ছিলেন, যে মিশন নিয়ে তিনি শিকাগো শহরে উপস্থিত হয়ে ছিলেন, শিকাগো শহরের বুকে প্রায় মধ্য রাতে সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার। তিনি এখন কি করবেন ? এখন তাঁর কি করা উচিৎ? তিনি কি দেশে ফিরে আসবেন? এ কথা সকলেই জানেন যে, স্বামীজী ছিলেন ধীর স্থির স্থিতধী সম্পন্ন একজন পুরুষ। তিনি স্থির করলেন যে, শিকাগো শহরে তিনি আরও কিছুদিন থেকে যাবেন। কিন্তু আর একটি গুরুতর সমস্যা প্রকট হয়ে তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হলো। তাঁর হাত খরচের টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য ন্যুনতম যে টাকা দরকার তা তাঁর কাছে আর নেই। সেই সঙ্কটময় সময়ে তিনি খোঁজ পেলেন শিকাগো থেকে অনেক দূরে বোস্টন শহরে থাকা খাওয়ার খরচ অনেক কম। অবশেষে প্রায় কপর্দক শূন্য অবস্থায় স্বামীজী ট্রেনে চেপে বোস্টন শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। আর সেকানেই ঘটলো সিনেমার গল্পের মতো নাটকীয় এক ঘটনা। ট্রেনে তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছিল বোস্টন শহরের ধনী পরিবারের একজন প্রভাবশালী মহিলার সাথে। যিনি আসলে ছিলেন আমেরিকার একজন বিখ্যাত লেখিকা এবং একই সাথে একজন শিক্ষিকা। তার নাম মিস কেট সেন্ডবর্ন। স্বামীজীর সাথে তার সামান্য আলাপ চারিতায় তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়ে ছিলেন যে, তিনি স্বামীজীকে বোস্টন শহরে তার খামার বাড়িতে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। প্রায় কপর্দক শূন্য স্বামীজীর সেই আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে কোন উপায় ছিলনা। জেনে অবাক ও বিস্মিত হবেন যে, বোস্টন শহরে সেই খামার বাড়িতে থাকা কালীন সময়ে মিস কেট সেন্ডবর্নের সৌজন্যে স্বামীজী খুব তাড়াতাড়ি সেই শহরের শিক্ষিত সমাজের কাছে এক সুপরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন। আবার এখানেই ঘটেছিল আর এক নাটকীয় চমক। স্বামীজীর সাথে সেখানেই পরিচয় হয় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সুপ্রসিদ্ধ জ্ঞানী পুরুষ অধ্যাপক জন হেনরী রাইট সাহেবের সাথে। স্বামীজীর পান্ডিত্য এবং প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে রাইট সাহেব স্বামীজীকে জিজ্ঞাসা করে ছিলেন , আপনি কি শিকাগো ধর্ম মহাসভায় যোগদান করছেন ? উত্তরে স্বামীজী যখন বললেন যে, তাঁর তো কোন পরিচয় পত্রই নেই। নেই কোন রিকমেন্ডেশন লেটার। ধর্ম মহাসভায় তিনি যোগদান করবেন কি কিভাবে ? তখন অধ্যাপক রাইট সাহেব বলেছিলেন, “ To ask you swami , for your credentials is like , asking the Sun to state its right to shine “. যার অর্থ হলো – আপনার পরিচয়পত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করার অর্থ হলো সুর্যকে প্রশ্ন করা , তার কিরণ দেওয়ার অধিকার আছে কিনা? “
(চলবে)