“ম্রো’ আদিবাসীর গো হত্যা’ অনুষ্ঠাণ ” - তানিয়া শারমিন

Home Page » ফিচার » “ম্রো’ আদিবাসীর গো হত্যা’ অনুষ্ঠাণ ” - তানিয়া শারমিন
মঙ্গলবার ● ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২


 ম্রো’ আদিবাসীর গো হত্যা’ অনুষ্ঠাণ

প্রতিটি ধর্মে যেমন কিছু নিজস্ব উৎসব থাকে তেমনি সারা বিশ্বেই কিছু অঞ্চল ও ছোট ছোট নৃ-গোষ্ঠির মানুষরাও পালন করে তাদের বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন    সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত আচার অনুষ্ঠান। মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ে এটা বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশেও রয়েছে সেই চর্চা। বান্দরবান জেলার ‘ম্রো’ এবং ‘খুমী’ সম্প্রদায়ে ধর্মীয়ও অনুষ্ঠানের পর ঐতিহ্যগত সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘গো হত্যা’। প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে তা পালন করা হয়।
তাদের বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা ‘ম্রো’ সম্প্রোদায়কে সৃষ্টির পর তাদের শিক্ষার সুবিধার জন্য আলাদা অক্ষর বা লিপিমালা তৈরী করে কলা পাতায় তা লিখে একটি গরুকে দিয়ে বলেন ‘ম্রো’দের কাছে তা পোঁছে দিতে। গরু আদেশ মতো তা নিয়ে রওনা হয়। কিন্তু মাঝপথে সে এতোই ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে  যে সব ভুলে পাতাটি খেয়ে ফেলে। এদিকে ‘ম্রো’রা তাদের বর্ণমালার জন্য বার বার সৃষ্টিকর্তা কাছে প্রার্থনা করতে থাকে। সৃষ্টিকর্তা তখন গরুটিকে আবার ডেকে পাঠান এবং জানতে চান ঐ কলাপাতাটি সে পৌঁছে দিয়েছে কিনা। গরু তার অপরাধ স্বীকার করে বলে পথে সে এতোই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল যে সহ্য করতে না পেরে ভুলে তা খেয়ে ফেলেছে। সৃষ্টিকর্তা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে গরুটিকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যতোদিন আবার ‘ম্রো’দের বর্ণমালা সৃষ্টি না হবে ততোদিন পর্যন্ত তাকে কলা গাছের সাথে একদিন একরাত বেঁধে রেখে নেচে গেয়ে আনন্দ করে তাকে হত্যা করা হবে। তার আগে জীবিত অবস্থায় তার জীব কেটে নেয়া হবে। সেই থেকে ম্রো’রা ‘গো হত্যা’ (‘ম্রো’ ভাষায় ‘চিয়াসদ পই’) নামক অনুষ্ঠানটি নিয়মিত পালন করে আসছে।
এই অনুষ্ঠান ‘ম্রো’রা বিভিন্ন রকম মানত করে থাকেন। যেমন দীর্ঘদিন চিকিৎসায় ভাল হয় না এমন রোগ থেকে মুক্তি, জুম চাষে ভাল ফসল ফলন ইত্যাদি।
অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি হিসাবে এক সপ্তাহ ধরে যুবক যুবতীরা কলা পাতা সংগ্রহ করে, ধান ভাঙ্গে, পানি তোলে আর বাড়ীর কর্তারা মদ, চুয়ানি ইত্যাদি সংগ্রহ করে। অনুষ্ঠানের আগের রাতে আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দেয়া হয়।
সন্ধা থেকেই শুরু হয় উৎসব। এলাকার মাঝখানে একটি গাছ পুতে গরুটিকে সেখনে বেঁধে রাখা হয়। যুবকরা তাদের বাঁশি আর মেয়েরা তাদের ঐতিহ্যগত পোশাক ও অলংকার দিয়ে সাজে। রাত নামার সাথে সাথে বয়স্করা একধরনের পিতলের থালা বাজিয়ে শুরু করে নাচ। খানিক পর যুবকরা বাঁশি বাজিয়ে যুবতীদের নাচার আহ্বান জানালে মেয়েরা দল বেঁধে নাচ শুরু করে। বিবাহিত পু্রুষ মহিলারা হলুদ আর চালের গুড়া পানির সাথে মিশিয়ে গায়ে মেখে নাচের আসরে যোগ দেয়। সকাল পর্যন্ত চলে এই নাচের পালা। সকাল হওার সাথে সাথে কাঁচা বাঁশে ফুলগুজে সারাবাড়ী সাজিয়ে রান্না করা শুকর আর মুরগির মাংস দিয়ে নাস্তা করে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হয় নাচ। যাকে ‘ম্রো’ ভাষায় ‘পাংইয়ং’ বলে। । দুই তিন ঘন্টা ধরে চলে এই নৃত্য। অনুষ্ঠানের কর্তার অনুমতি নিয়ে মুরুব্বীরা ঘরে তৈরী কম্বল গরুর গায়ে জড়িয়ে তাকে পানি পান করান। তারপর বর্শা এবং বাঁশ দিয়ে গরুটিকে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। শাস্তিস্বরূপ জীবিত গরুর জিহ্বা কেটে ঐ গাছের সাথে গেথে রাখে। যেন তারা জীবনে আর এই ভুল না করে।

রাতের খাবার রান্না করা হয় ঐ গরুর মাংস দিয়েই । অতি ঘনিষ্ঠ ও সম্যানিত্ব আত্মীয়দের আপ্যায়ন করা হয় গরুর রান এবং সিনার মাংস দিয়ে। এই ভাবেই সম্পন্ন হয় ‘গো হত্যা’ অনুষ্ঠান।
উল্লেখ্য এখনো তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত ‘ম্রো’দের এই ভাষা আলাদা ভাবে পড়ানো হয়।

তানিয়া শারমিন

তানিয়া শারমিন; ফ্রিল্যান্সার

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫৭:৪৩ ● ১৪০৬ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ