( একজন নির্বাচন কমিশনার, একজন আমলা ও একজন সাহিত্যিকের প্রতি শ্রদ্ধা )
এইভাবে একজন অপরিচিত আমলা, একজন সুসাহিত্যিক আমাদের ভাই হলেন, মাহবুব ভাই, হলেন আমাদের অভিভাবক ও উপদেষ্টা। মাঝে মধ্যে তিনি আমাদের মহড়াস্থলেও এসেছেন। আমরা তখন মতিঝিল টিএনটি কলেজের একটি কক্ষে সন্ধ্যার পর প্রতিদিন রিহার্সেল করতাম।
তখন রিহার্সেল করার জায়গা পাওয়া খুব কঠিন ছিল। আরও দু’একটি গ্রুপ এখানে রিহার্সেল করতো। অনেক গ্রুপের নাম এখন আর মনে নেই। তবে নোটক ও চলচ্চিত্র অভিনেতা সাদেক হোসেন বাচ্চুর গ্রুপও এখানে রিহার্সেল করতো। মাঝে মাঝে এখানে চলে আসতেন চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। তিনি কোন নাটকে অংশ নিতে নয়, সখের বসেই এসে বসে সময় কাটাতেন। অতি সাধারণ পোষাকে থাকতেন সর্বদাই। পায়জামা-পাঞ্জাবী ছিল তাঁর অধিকাংশ সময়ের পরিধেয়। যাক, মাহবুব তালুকদার আমাদের উপদেষ্টার মতো কাজ করতেন। সব সময় নজর রেখেছেন। আমরা এখন নাটক করিনা। কিন্তু মাহবুব ভাইয়ের সান্নিধ্য ও যে স্নেহ স্পর্শ লাভ করেছি, তা ভুলার মতো নয়। তাঁর হাতে লেখা চাঁদাবাজ নাটকটি ফটোকপি করে আমরা নিয়েছি। আজও তাঁর লেখা নাটকের একটি কপি সযতনে আমার কাছে রক্ষিত আছে।
নাটকটি খুবই বাস্তবতার নিরীখে তিনি লিখেছিলেন। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ব এবং পুলিশের অসহায়ত্ব তিনি তুলে ধরেছেন নাটকে। তখন দেশে কোন আইনের শাসন ছিল বলে মনে হতো না। স্বৈরাচার তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় জেঁকে বসে আছে।
নাটকটির শুরুতেই মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যেতো। তারপর হঠাৎ মঞ্চের উপরে হৈ চৈ,দৌড়াদৌড়ি, পুলিশের হুইসেল এবং পিছু পিছু দৌড়ানো । পর পর কয়েকটি বোমা বিষ্ফোরণ এই সব মঞ্চটিতে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দর্শক কৌতুহল নিয়ে পিনপতন নিস্তব্দতায় মঞ্চের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখে। বলাবাহুল্য, আমার ছেলে স্বনন তখন ছোট। নাটক দেখতে এসে তার মায়ের কোলে ভয়ে জোরে কান্না শুরু করে দেয়। নাটকে আমার একটি ছোট্ট ভুমিকা ছিল। একজন পুলিশ কর্মকর্তা। অভিনেতাদের এই চরিত্রটি রূপায়ণে তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করলাম না, কারন ভূমিকা অনেক ছোট বলে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম , আমিই করবো। চরিত্রটি খুব সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, আমি অফিসে বসে আছি। এমন সময় আমার দুই সহকর্মী একজন আসামী ধরে নিয়ে এলো। আসামীর সাথে আবার দুজন লোক স্বেচ্ছায় আসলো। আমি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা। তাই আসামীকে ছেড়ে না দিয়ে হাজতে নিতে নির্দেশ দিলাম। সাথে আসা লোক দুটি বাধা দেয়। তারা এমন ভাব দেখায় যে, কোন কিছু পরোয়া করে না। চাঁদাবাজিকে তারা অপরাধ বলে মনেই করে না। এ দিকে আমি নিষ্ঠাবান পুলিশ। আপোষ করতে জানি না। এ সবই কিন্তু নাটকের লিখা সংলাপের বাইরে আমাকে করতে হয়েছিল। তার একটা বিশেষ কারণ আমার কাছে মনে হয়ে ছিল। আবার নাটক তো দর্শক এমনি এমনি দেখবে না। আকর্ষণ থাকতে হয়। মানুষ নাটক দেখে সম্মোহিত হয়ে যায়। সেই নেশায় নাটকের পাত্র-পাত্রীর সাথে হাসে, কাঁদে, সহানুভুতিশীল হয়, ইত্যাদি। নাটকের দুএকটি ওয়ার্কশপে দেখেছি যাদুকরদেরকে প্রশিক্ষণ নিতে। কারণ যাদু দেখাবার সময় অহেতুক কিছু ভীতিপ্রদ সংলাপ আওড়াতে হয়। বলতে থাকে, আপনারা দয়া করে কোন শব্দ করবেন না। এই খেলাটি অত্যন্ত জটিল কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ ভাবে সবাইকে সম্মোহিত করে। যাক, ফিরে আসি নাটকের কথায়। বিপত্তি বাঁধে আইনের ধারা নিয়ে। খেলনা পিস্তল দিয়ে ওরা ডাকাতি করে। গুলি গুলোও তেমনই। এই মুহুর্তে কি করণীয় তা বুঝতে না পেরে শুধুই আইনের ধারা নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছি। সহকর্মীকে নির্দেশ দিলাম গুলির বিষয়ে কি লিখা আছে তা খুঁজে দেখতে। আর আমি দেখছি খেলনা পিস্তল সম্পর্কে। এমন সময় আসামী পক্ষের লোকটি কথা বলতে চাইলে এমন ভাব দেখাই যে ,আমি সাধারণ কোন পুলিশ অফিসার নই। আর কাজের সময় কোন ধরনের বাজে আলাপ সহ্য করি না। কারো কোন সুপারিশ আমি গ্রহণ করি না। কিন্তু নাটকের মুল কাহিনীতে শুধু ছিল , তখন একটা ফোন আসে। আর পুলিশ অফিসার ধরে নিয়ে আসা চাঁদাবাজকে ছেড়ে দেয়। আমি চিন্তা করে দেখলাম, দর্শক ব্যাপারটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবে না। তাই একটু প্রলম্বিত করতে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আমি ফোনের অপর প্রান্তের আলাপের অংশ বিশেষ দর্শকদের বুঝাতে চেষ্টা করি। প্রথমে ফোন ধরবো না বলি। চাঁদাবাজরা বলছে , ফোনটা ধরে দেখুন স্যার। আমি উত্তেজিত । বলি যে, আমার সময় নষ্ট করবেন না। কোথাকার কে ফোন দিয়ে আমার কাজের সময় বিরক্ত করবে , আমাকে তেমন অফিসার ভাববেন না। আমি কোন ফোনে বিশ্বাসী অফিসার নই। অবশেষে ফোন ধরে অপর প্রান্তের লোকটিকে ধমকের সুরে বলি, ফোন দিয়ে আমাকে আর কোন দিন ডিস্টার্ব করার সাহস করবেন না। আমি তেমন অফিসার নই। হঠাৎ সুর একান্ত নরম। ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ। জ্বী স্যার !! বলেই উঠে দাঁড়িয়ে খুব জোরে একটা স্যালুট দিয়ে কথা বলতে থাকি। আমার অন্য কনস্টেবলদের বলি স্যালুট দিতে, তারা বুটের শব্দ করে জোরে স্যালুট দেয় আমার সাথে। আমি নার্ভাস হয়ে বলতে থাকি, জ্বী স্যার !! আমার ভুল হয়ে গেছে স্যার !! ওরা আপনার লোক, এই কথা জানলে কি আর ধরে নিয়ে আসতে হুকুম দেই !! না স্যার !! এখনই স্যার ওদেরকে ছেড়ে, নানা স্যার সত্যি বলছি স্যার !! আমরা স্যার !! বলেন কি স্যার!! না স্যার ! আমাকে যত খুশি গালি দেন স্যার আপত্তি নাই , তবে আমার মা-বাবাকে -না না স্যার বলেন স্যার তাতে কোন মানা করবো না স্যার । আমার মা-বাবাকেও আপনি দয়া করে গালি দিতেই তো পারেন স্যার! আপনি একটু ফোনটা ধরেন স্যার, আমি এক্ষণই আমার কনস্টেবলদের একটু শাসন করি , যাতে আর কোনদিন এমন যাকে তাকে থানায় নিয়ে আসে স্যার। আমি বলতে থাকি-আমরা হলাম পুলিশ । মানে শান্তি রক্ষক। আর যখন তখন যাকে তাকে থানায় ধরে এনে কি যে অশান্তি সৃষ্টি করেন আপনারা !! এ তো মেনে নেয়া যায় না। ফোন মুখের কাছ থেকে একটু দুরে সরিয়ে হাতে নিয়ে কনস্টেবলকে বেশ কিছুক্ষণ গালি দিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করি। শেষে আবার ফোনে কথা বলতে গিয়ে আবারও কনস্টেবলকে বলি-আপনি একটা গরু !! না স্যার আপনাকে না আপনাকে না,আপনাকে গরু বলিনি স্যার! আমার বলদটাকে গালি দিতেছি স্যার ! নানা সত্যি বলছি স্যার , আমি আপনেরে বকা দিমু এমন সাহস আমার কই স্যার। দেখেন না স্যার, কি আহম্মক কনস্টেবল গুলোরে আমার কাছে পাঠাইছে। তখন আঞ্চলিক ভাষায় ফোনে কথা বলতে থাকি। এমন করে দীর্ঘক্ষণ চলে আমার ফোনালাপ। অবশেষে আমার গাড়িতে করে তাদেরকে যথাস্থানে সসম্মানে পৌঁছে দিতে নির্দেশ দেই। এখানে যত সংক্ষেপে বলেছি সংলাপটি ততো সংক্ষেপে ছিল না। আর সব টুকুই ছিল অলিখিত। শেষে আমার অনুজ প্রতিম পরিচালক ফারুক বলে ছিল যে, স্বপন দা, আপনার জন্য কোন ডিরেকশন নেই আমার। আর মাহবুব ভাই স্টেজ থেকে নামার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বলে ছিলেন , এমন সংলাপের কথা তো ভাবিনি। ধন্যবাদ আপনাকে। নাটকটির বিশেষ আকর্ষণ ছিল আমার অলিখিত সংলাপ। এটা অন্য কেউ চালাতে সক্ষম ছিল না। ( চলবে )