গুরুকুলের প্রতি শিক্ষাঋণের স্বীকারোক্তি ও অনুকরণীয় শ্রদ্ধা নিবেদন: পর্ব-২
এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান সম্পর্কে লিখেছেন,
“ স্যার আমাদেরকে বাংলা গদ্য পড়াতেন। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, থেকে আধুনিক বাংলা গদ্যের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় ও সরলভাবে আমাদের কাছে উপস্থাপন করতেন। আমরা অত্যন্ত অমনোযোগী ছাত্ররাও লক্ষ্য করতাম স্যার অত্যন্ত কঠিন বিষয়কে কোথাও কোন সংশয় বা জটিলতা ছাড়া উপস্থাপনা বা ব্যাখ্যা করে কিভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমাদেরকে অভিভূত করে রাখতেন। ক্লাসের পাঠদানের বাইরে স্যারের ছিল বিপুল রচনা সম্ভার, গবেষণা, বক্তৃতা, সৃজনশীল ও মননশীল সৃষ্টি,কর্মকান্ড। এক জীবনে এতো বহুমুখী প্রতিভা এবং বর্ণ বৈচিত্রময় রচনা, যা “ হাসি-বুদ্ধির বিদ্যুৎস্পষ্ট ” বলে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের রচনা সম্ভারের সাথে তুলনীয় বলেই আমি মনে করি। “ । এই বইটি পড়ার মাধ্যমে পাঠকগণ অনেক নিগূঢ় তথ্য জানতে সক্ষম হবেন বলে আমার কাছে মনে হয়।
তিনি ড. আনিসুজ্জামানের রচনা-রীতিকে নিয়ে লিখেছেন,
” সমস্ত রচনা রীতি একান্তই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। দৃষ্টি স্বচ্ছতা ও মনের মুক্তি তাঁর রচনা-রীতিকে স্বাতন্ত্রমন্ডিত করেছে-যা সংক্ষেপে নিম্ন রূপভাবে মূল্যায়ন করা যায়।
ক) তাঁর রচনা মেদহীন, সংযম পূর্ণ এবং অতি কথন বর্জিত।
খ) তিনি বাক্যকে বক্র বা ভাষাকে দুরূহ করেননি।
গ) ভাষার শৃংখলা, বিশুদ্ধতা, তার সরসতাই তাঁর রচনা শিল্পতা।
ঘ ) তাঁর রচনা চিন্তা, কিন্তু ভারি নয়, সর্বত্র সরস, স্বচ্ছ ও স্বাদু। “
কি অসাধারণ বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনায় এক মহর্ষীর যাবতীয় সৃষ্টি-সম্ভার সম্পর্কে মূল্যায়ন এখানে তুলে ধরেছেন । জানতে আগ্রহী পাঠকদের নিকট বহু বিশ্রুত ড. আনিসুজ্জামানকে সরলভাবে তুলে ধরেছেন। এখানেও লেখক একটা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিলেন। আমরাও আমাদের এই আলোক প্রজ্বলনকারী খাঁটি দেশ প্রেমিক প্রিয় ব্যক্তিকে গভীর ভাবে জানতে সক্ষম হতে পেরেছি। একজন শিক্ষাগুরুর সমগ্র রচনার একটা ধারণা মাত্র কটি লাইনে তুলে ধরেছেন যে, অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য অনায়াসে তাঁকে জানতে সহায়ক হবে। ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার, স্বাধীনতার স্বপক্ষে তার ভুমিকা ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট, নষ্টদের বিরুদ্ধে ছিলেন অকুতভয় এক সৈনিক। সকল সুন্দরের পক্ষে সদা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে তিনি ছিলেন নির্ভীক সৈনিক। শিক্ষকতা পেশার বাইরেও তিনি তাঁর নাগরিক দায়িত্বকে গুরুত্ব দিতেন অসংকোচে।
ড. আনিসুজ্জামানের মানবিক গুণ সম্পর্কে জানা যায় বইটি পড়ে। আমরা যারা নিকট থেকে এই মহান ব্যক্তিটিকে জানতে পারিনি, তাদের জন্য যথেষ্ট উপকরণ মিলবে এখানে। বহু বিস্তৃত ও বিশ্রুত ঘটনার মধ্যেও দু’ একটি দৃষ্টান্ত লেখককে আকৃষ্ট করেছে। পাঠকবৃন্দও নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন তাঁর বিশাল হৃদয়ের সুন্দর দিকটিকে, যা তাঁর ভক্ত মহলে আরও বহুগুণ শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেবে। তিনি লিখেছেন, ” সন্তানতুল্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে স্যারের উদার মানসিকতা ও পিতৃতুল্য আদর অক্ষুন্ন ছিল।” একটি উদাহরণ দিয়ে একটি ঘটনার বর্ণনায় বলেন-চন্দ্রশেখর পুরোহিত ট্রেন দুর্ঘটনায় পতিত হন। তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। স্যার ( আনিসুজ্জামান ) খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে আসেন। চারিদিকে ছুটোছুটি করে রক্ত যোগার করা সহ প্রয়োজনীয় ঔষধাদির ব্যবস্থা করেন। এই সব কর্তব্য একজন শিক্ষককে মহিমান্বিত করেছে, করেছে পিতৃতুল্য। তিনি গতানুগতিক শ্রেণীকক্ষে বক্তৃতা দেবার বাইরেও ছিলেন স্নেহ প্রবণ ও দায়িত্বশীল।
(চলবে)