জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”- রুমা আক্তার

Home Page » ফিচার » জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”- রুমা আক্তার
বুধবার ● ১৭ আগস্ট ২০২২


জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”

ডাউন সিনড্রোম একটি জেনেটিক বা জিনগত ত্রুটি। মানবদেহে কোষের ২১ তম ক্রোমোজমের অসামঞ্জস্যতার কারণে ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্মায়। এ সমস্যা সৃষ্টি হলে কোষের ২১ তম ক্রোমোজমটিতে ২ টির জায়গায় ৩ টি ক্রোমোজম হয়ে যায়। এটিকে ” ট্রাইজোমি -২১” ও বলা হয়। এজন্য ২১ মার্চকে ‘বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম’ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর বুদ্ধিমত্তা নিম্নমানের হয়ে থাকে।

ডাউন সিনড্রোমের ইতিহাস -

ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে মানুষ ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতো না। ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাংডন হেডন ডাউন মানসিক প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনা করার জন্য ১৮৬৬ সালে ইংল্যান্ডের সারে শহরে একটি প্রতিবন্ধী আবাসস্থলে দায়িত্ব পান। সেখানে তিনি দেখতে পেলেন প্রতিবন্ধীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের চেহারা অন্যদের থেকে ভিন্ন অর্থাৎ কারো মুখ চ্যাপ্টা আবার কারো ঘাড় ছোট।তিনি এদের নাম দেন ” মোঙ্গলয়েড”। এরপর তিনি পৃথকভাবে গবেষণা করে এর নাম দেন ” ডাউন সিনড্রোম “। তারপর থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি ” ডাউন সিনড্রোম ” নামেই পরিচিত। এজন্য জন ল্যাংডন হেডন ডাউনকে ডাউন সিনড্রোমের জনক বলা হয়। এরও প্রায় ১০০ বছর পর ফ্রান্সের চিকিৎসক জেরিমি লিডোউন আবিষ্কার করেন যে, ২১ নং ক্রোমোজমে ২ টির জায়গায় ৩ টি ক্রোমোজম থাকে।

ডাউন সিনড্রোমের প্রকারভেদ -

সিডিসি-এর তথ্যমতে, ডাউন সিনড্রোম ৩ ধরনের হয়ে থাকে __

১. ট্রাইসোমি-২১ঃ

ডাউন সিনড্রোমের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধরণ এটি। কোষ বিভাজনের অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে অর্থাৎ কোষের ২১নং ক্রোমোজমে ২ টির জায়গায় ৩ টি ক্রোমোজম হলে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়। এর ফলে অতিরিক্ত ক্রোমোজম অন্য কোষে পুনরাবৃত্তি করে এবং শিশুদের বিশেষ কিছু শারীরিক ও মানসিক ক্রটি সৃষ্টি করে। ১০০% এর মধ্যে ৯৫% ক্ষেএেই এটি দেখা যায়।

২. মোসাইসিসমঃ

এটি সব কোষে না ও থাকতে পারে তবে কয়েকটা কোষে অতিরিক্ত ২১ তম ক্রোমোজমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।এর ফলে গর্ভসঞ্চারের সময় সুস্থ স্বাভাবিক কোষের পাশাপাশি বিকৃত কোষ ও জন্ম নেয়।১০০% এর মধ্যে ১% ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়।

৩. ট্রান্সলোকেশনালঃ

মানবদেহের কোষের ২১ তম ক্রোমোজমটি ভেঙে গিয়ে অন্য আরেকটি ক্রোমোজোমের সাথে যুক্ত হয়। ১০০% এর মধ্যে ৪% ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়।

ডাউন সিনড্রোমের কারণ

অনেকেই মনে করেন যে, শুধুমাত্র বয়স্ক নারীরাই ডাউন সিনড্রোম শিশুর জন্ম দেয় এটা আসলে একটা ভ্রান্ত ধারণা। যেকোনো বয়সের নারীরা ডাউন সিনড্রোম শিশুর জন্ম দিতে পারে। তবে নারীর বয়স যত বাড়তে থাকবে, গর্ভের সন্তান তত প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভবনা থাকবে। ৩৫ বছর বয়সের পর প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সে সন্তান প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

বাবা-মার কারনেও এই সমস্যা হতে পারে। শিশুটি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বাবার ক্ষেত্রে ৩% এবং মায়ের ক্ষেত্রে ১৫% ঝুঁকি বহন করে। এছাড়া ও প্রথম সন্তান যদি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত হয় তাহলে পরবর্তী সন্তান ও ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডাউন সিনড্রোম শুধু মায়ের বয়স ও বংশগতির জন্য দায়ী নয় বরং এর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ ও তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদির জন্য ও দায়ী। এ ধরনের শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় কম হয়।

ডাউন সিনড্রোমের লক্ষ্মণ -

ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের লক্ষ্মণই প্রকাশ পায়। নিচে তা আলোচনা করা হলো–

শারীরিক লক্ষ্মণঃ

১. মাংসপেশির শিথিলতা।
২. মাথা আকারে ছোট ও উচ্চতা কম।
৩. নাক চ্যাপ্টা।
৪. চোখের কোনা উপরের দিকে উঠানো।
৫. জিহ্বা বের হয়ে থাকা ও লালা ক্ষরণ।
৬. হাতের তালুতে একটিমাত্র রেখা থাকে।

মানসিক লক্ষ্মণ

১.কথা বলতে বেশ সময় লাগে।
২. বুদ্ধিমত্তা নিম্নমানের হয়।
৩. শিশু অমনোযোগী হয়।
৪. বেশি আক্রান্ত হলে বাক- শক্তি হারিয়ে ফেলে।

চিকিৎসা

ডাউন সিনড্রোমের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই, জটিলতা দেখা দিলে তার চিকিৎসা করতে হয়।পূর্ব হতে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য পেতে পারে।এতে তার সামাজিক আদান-প্রদান, সূক্ষ্ম পেশির কাজ,জীবনধারণের ক্ষমতা ইত্যাদি উন্নতি করা যেতে পারে।

প্রতিরোধে উপায়

১. মেয়েদের ছোট বেলা থেকেই ফলিক অ্যাসিড খাওয়াতে হবে।
২. গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে।
৩. অতিরিক্ত ঔষুধ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুকে লালন-পালন না করা।
৫. শিশুকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
৬. সঠিক সময়ে লক্ষ্মণগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে।
৭. শুধুমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নয় বরং এগিয়ে আসতে হবে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানকেও তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সুস্থভাবে জন্মগ্রহণ এবং সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারবে।

রুমা আক্তার
শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ
গর্ভমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সাইন্স
আজিমপুর,ঢাকা।

বাংলাদেশ সময়: ১:২৭:২৫ ● ১২৬৫ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ