বঙ্গনিউজ : বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত একটি রাস্তায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কংক্রিটের বিশাল গার্ডার ক্রেন দিয়ে তোলার সময় চলন্ত গাড়ির ওপর পড়ে পাঁচ জন নিহত হয়েছেন।
সোমবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে উত্তরা জসীমউদ্দীন রোডের মোড়ে বিপণিবিতান আড়ংয়ের সামনে এই ঘটনা ঘটে। এর প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর গার্ডারটি সরিয়ে মরদেহগুলো বের করে আনেন উদ্ধারকর্মীরা।
নিহতদের সবাই একই পরিবারের সদস্য বলে জানা গেছে।
তারা একটি বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে ঢাকার কাওলা থেকে আশুলিয়ার দিকে যাওয়ার পথে গার্ডারটি ধসে পড়ে।
গার্ডারের নীচে পিষ্ট হয়ে যাওয়া গাড়িটি থেকে আহত অবস্থায় নবদম্পতিকে উদ্ধার করা হয়। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ও শঙ্কামুক্ত আছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
নিহতদের মধ্যে ছিলেন বরের বাবা, কনের মা, খালা ও খালাতো ভাইবোন।
ঢাকায় একটি সমন্বিত গণ-পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে টঙ্গি থেকে বিমান বন্দর হয়ে প্রধান সড়কটির ওপর দিয়ে যে বাস র্যাপিড ট্রানজিট তৈরি করা হচ্ছে, জসীমউদ্দীন সড়কে সেই প্রকল্পের একটি নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নীচে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের কাজ চলছে রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ত একটি সড়কের ওপর।
যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে
বাস র্যাপিড ট্রানজিটের ফ্লাইওভারের পিলারগুলোর ওপর বিরাট বিরাট কংক্রিটের গার্ডার বসানোর কাজ চলছে গত বেশ কিছুদিন ধরেই। বড় বড় ক্রেন দিয়ে এই গার্ডারগুলো পিলারের ওপর তোলা হয়।
ভবন তৈরির সময় যেরকম ছাদের ভার বহনের জন্য বিম বসাতে হয়, তেমনি ফ্লাইওভারের ক্ষেত্রে পিলারের ওপর বসানো হয় গার্ডার।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, সোমবার ক্রেন দিয়ে গার্ডার তোলার সময় ক্রেনটি হেলে যায়, এরপর গার্ডারটি পড়ে চলন্ত গাড়ির ওপর। এসময় ব্যস্ত রাস্তাটি দিয়ে অনেক গাড়ি চলাচল করছিল।
একটি ছবিতে দেখা যায়, গার্ডার বহনকারী ক্রেনটি একপাশে হেলে পড়েছে এবং গার্ডারটি আছড়ে পড়ে ওই প্রাইভেট কারের ডান পাশের একটি অংশকে সম্পূর্ণ পিষ্ট করে ফেলেছে।
গাড়ির ভেতর থেকে দুজনকে টেনে বের করা গেলেও পাঁচ জন চাপা পড়ে নিহত হয়েছে ঘটনাস্থলেই। এরা সবাই একই পরিবারের সদস্য বলে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনরা।
যেভাবে মরদেহ উদ্ধার হল
নিহতদের গাড়ির ভেতর থেকে বের করে আনতে সনাতন যন্ত্রপাতি দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিটকে বেশ বেগ পেতে হয়।
প্রাথমিকভাবে দমকল কর্মীরা গাড়ির দরজা ও ছাদ হাইড্রোলিক কাটার দিয়ে কেটে গাড়ির ভেতরে ঢুকে মরদেহগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্ঘটনার চার ঘণ্টা পরও তারা নিহতদের বের করে আনতে পারছিলেন না।
পরে একজন ক্রেন চালককে দিয়ে হেলে পড়া ক্রেনটি আবার সোজা করা হয়। এরপর সেই ক্রেন দিয়ে কংক্রিটের ভারী গার্ডারটি সরিয়ে তারপর রেকার দিয়ে গাড়িটি টেনে বের করে হয়।
এরপর ভেতর থেকে পাঁচ জনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে দমকলবাহিনী। সবার লাশ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
নিহতরা হলেন ৬০ বছর বয়সী রুবেল মিয়া, ৩৭ বছর বয়সী ফাহিমা, ২৬ বছর বয়সী ঝর্ণা, ৬ বছর বয়সী জান্নাতুল, ৪ বছর বয়সী জাকারিয়া।
এদিকে এই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দুই চীনা নাগরিকসহ ৪ জনকে ঘটনাস্থল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে দুর্ঘটনার পর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ঘটনাস্থলে কৌতূহলী জনতার ভিড়ে ব্যাপক বেগ পেতে হয় উদ্ধার-কর্মীদের। সেইসাথে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় টর্চ জ্বালিয়ে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করতে দেখা গেছে দমকলকর্মীদের।
এ ধরণের ভারী গার্ডার সরানোর কোন যন্ত্র দমকলবাহিনীর কাছে নেই। এজন্য মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যবহৃত ১৫০ টনের রেকার আনার কথা থাকলেও সেটা ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পাঁচ ঘণ্টা পর। ততোক্ষনে উদ্ধারকাজ সম্পন্ন হয়ে যায়।
পরে মেট্রোরেলের ক্রেনটি দিয়ে গার্ডারটি রাস্তা থেকে সরানো হয়।
এদিকে যে ক্রেন দিয়ে এই গার্ডারটি সরানো হচ্ছিল সেটি এতো ভারী গার্ডার সরানোর মতো ধারণ ক্ষমতা রাখে কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ঘটনাস্থলে এসে এমআরটি এক প্রকল্প কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, একেকটি গার্ডারের ওজন ৪০ টনের বেশি হয়ে থাকে, সেগুলো এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিতে অন্তত ১০০টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এখানে যে ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে সেটির ধারণক্ষমতা এতোটা ছিল না বা যান্ত্রিক ত্রুটিও হয়েছে কিনা সেটা দেখার বিষয়।
সাধারণত কোন উন্নয়নকাজে এ ধরণের গার্ডার বসানোর কাজ যখন চলে, তখন ওই সড়কটি বন্ধ রাখা হয় এবং সাময়িক চলাচলের আরেকটি বিকল্প পথ তৈরি করা হয়।
উল্লেখ্য বিআরটির এই প্রকল্পটি ২০১২ সালে একনেক সভায় অনুমোদন পেলেও এর কাজ শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে, যা এখনও চলছে।
নির্মাণাধীন প্রকল্পে যতো দুর্ঘটনা
বিআরটি প্রকল্পে এমন দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে।
গত মাসে গাজীপুরে একই প্রকল্পের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। আহত হন আরও দুজন। ফ্লাইওভারের কাজ করার সময় লঞ্চিং গার্ডারটি গাড়িতে উঠানোর সময় সেটি কাত হয়ে পড়ে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে।
গত বছরের ১৪ মার্চ ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ে চারজন আহত হন। তাদের মধ্যে দুজন চীনের নাগরিক ছিলেন। ক্রেনের মাধ্যমে গার্ডারটি তুলে ফ্লাইওভারে স্থাপনের সময় সেটি ছিটকে পড়ে।
এর আগে উত্তরার আবদুল্লাহপুরে গভীর রাতে এ প্রকল্পের পিয়ার ক্যাপ নামে গার্ডারের একটি অংশ ধসে পড়ে। তবে সেখানে কেউ হতাহত হননি।
নির্মাণাধীন প্রকল্পে দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জন প্রাণ হারানোর ঘটনাটি। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর চান্দগাঁও থানায় ২৫ জনকে আসামি করে মামলা হলেও আজও শেষ হয়নি মামলার বিচার কাজ। সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না হওয়ায় এখনও ঝুলে আছে।
এছাড়া চলতি বছর ১৬ই জুন সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে নির্মাণাধীন জাদুকাটা সেতুর একটি গার্ডার পিলার ঢলের পানিতে ধসে পড়ার ঘটনা ঘটে।
৭ই জুন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় নির্মাণাধীন একটি সেতুর গার্ডার ধসে পড়ে এবং ২৮শে এপ্রিল রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়কে নির্মাণাধীন সেতুর গার্ডার ধসে এক জন করে শ্রমিক নিহত হন।
দুই দশক আগে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে নির্মাণাধীন একটি ফুটওভার ব্রিজ ধসে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।