বাংলা কথা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্য নাম । জননী তার প্রথম উপন্যাস । শ্যামা নামে এক গৃহবধূর জননী সত্ত্বার বহুবিধ আত্মপ্রকাশ এই উপন্যাসের উপজীব্য। উপন্যাসে লেখক জননী চরিত্রটিকে স্বর্গীয় বা দৈবিক মহিমায় ভাস্বর করেননি। বরং এক জননীর কাহিনী বাস্তবতার আয়নায় তুলে ধরেছেন। উপন্যাস বললে বরং ভুলই হবে, এ যেন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চিরন্তন ঘটে যাওয়া মানব জীবনের চক্রেরই স্বার্থক খণ্ডচিত্র।
উপন্যাসের মূল চরিত্র শ্যামা, যাকে ঘিরেই উপন্যাসের আবর্তন; এছাড়া শীতল, বিধান, বকুল, রাখাল, মন্দা এবং আরও অনেকে, যারা প্রেক্ষাপটের প্রয়োজনে হাজির হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে উপন্যাসে। উপন্যাসে শ্যামার কিশোরী বধূ থেকে যেমন পুরোদস্তুর গৃহবধূ হওয়ার কাহিনী আছে, তেমনি তার জননী হয়ে ওঠা, আবার জননীর রিলে বাটনটা হস্তান্তরের গল্পও তুলে ধরা হয়েছে সুনিপুণভাবে। এছাড়া সংসারে স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন, মানসিক দ্বন্দ্ব, আর্থিক টানাপোড়েন, স্বার্থপর-স্বার্থহীন সম্পর্ক, মানুষের চারিত্রিক রহস্যময়তা, বাস্তবতার কাছে স্বপ্নের পরাজয়ের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে নিপুণ দক্ষতার সাথে।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিপত্নীক শীতলের ঘরে বউ হয়ে আসে শ্যামা। শীতলের কোনো সন্তান ছিল না। বিয়ের পর দীর্ঘ সাত বছর শ্যামা অনুর্বরা থাকায় এই দম্পতি ছিল নিঃসন্তান। অবশেষে বন্ধ্যাত্বের অপবাদ ঘুচিয়ে শ্যামার কোল জুড়ে এল এক সন্তান। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই বাঁধভাঙা আনন্দে নেমে আসে এক রাশ কালো ছায়া। ১২ দিনের মাথায় স্বল্পদৈর্ঘ্য পৃথিবী ভ্রমণের সমাপ্তি টেনে মারা গেল সন্তানটি। তারপর আবার সন্তানের রিক্ততায় হতাশায় নিমজ্জিত হয় পরিবারটি। এ ঘন হতাশা কেটে যায় এক পুত্র সন্তানের জন্মের মাধ্যমে। দ্বিতীয়বারের মতো মা হবার উচ্ছ্বাসটা ঠিকভাবে উপলব্ধি ও উপভোগ করতে পারছিল না শ্যামা। বিধানকে নিয়ে ভয়ে ভয়েই দিন কাটত তার। এ সন্তান কি স্বল্পায়ু নিয়ে এসেছে, না দীর্ঘায়ু পাবে?
এই প্রশ্ন প্রতিদিন ঘুরত তার করোটিতে। সারারাত তাই সে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে থাকত এই ভয়ে যে না জানি কখনো আবার অন্ধকার এসে তার ছেলেটিকে তার কাছ থেকে গ্রাস করতে চাইবে। কিন্তু শ্যামার মাতৃত্ব এবার স্থায়ী হলো। আস্তে আস্তে ভয়-হতাশা কাটিয়ে একে একে তাদের কোল জুড়ে আসে আরো সন্তান। ধীরে ধীরে তার চার সন্তান বড় হতে থাকে। এদিকে শ্যামাও আস্তে আস্তে গৃহবধু থেকে পরিপূর্ণ জননী হয়ে ওঠে, কিংবা বলা যায় খামখেয়ালি স্বামী শীতলের জন্য হতে বাধ্য হয়।
যে সময়ের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি রচিত, সে সময় বাঙালি বধূদের পরম নির্ভরতার জায়গা ছিলো স্বামী। কিন্তু শ্যামার সেই নির্ভরতাটুকু কখনই সম্পূর্ণরূপে ছিলো না। বরং খামখেয়ালি, বেহিসেবী হওয়ার কারণে বারবার শীতলকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অবশেষে চরম বিপদে নিমজ্জিত হয়ে নিজস্ব ছাপাখানাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হয় সে। তারপর বেকার জীবনের সংসারে নেমে আসে নানা দুর্ভোগ। দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর পূর্ব অভিজ্ঞতার সুবাদে চাকরি পায় এক ছাপাখানায়। তার কর্মদক্ষতায় প্রসার হয় সেই ছাপাখানার। সে জন্য সে বাড়তি কদরও পায়। তাদের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে যেন ধীরে ধীরে। কিন্তু শীতল ছিল খামখেয়ালি, অদূরদর্শী ও অপরিণামদর্শী। ভবিষ্যৎ নিয়ে তার তেমন কোন ভাবনা বা পরিকল্পনা ছিল না। আর তাই সে তুচ্ছ কারণে স্ত্রীর উপর অভিমান করে, জেদের বশবর্তী হয়ে মারাত্মক ভুল করতেও দ্বিধা বোধ করে না।
ছাপাখানার মেশিন কেনার জন্য ছাপাখানার মালিক তাঁকে বিশ্বাস করে যে টাকা দেয়, শ্যামার ওপর জেদ করে সেই টাকা চুরি করে পালিয়ে যায়। এদিকে সেই ছাপাখানার মালিক বাড়ি এসে খোঁজ নেয়। পুলিশও তাকে খুঁজে বেড়ায় পলাতক আসামি হিসেবে। অপরদিকে শ্যামা পরিবার নিয়ে পড়ে যায় অকূল পাথারে। নিরুপায় শ্যামা পরিবার নিয়ে বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় শীতলের বোন মন্দার কাছে। সেখানে শুরু হয় শ্যামার অন্য আরেক রকম জীবন সংগ্রাম। শ্যামা তার জীবনের সকলটা নিংড়ে দেয় তার সন্তানদের পরিচর্যায়। তার আত্মত্যাগেই তার সন্তানেরা পরিপুষ্ট হতে থাকে।
শীতল কি ধরা পড়ে, তার কী শাস্তি হয়, শ্যামা কীভাবে পরিবার সামলায়, ঘটনা কি এখানেই শেষ হয়, এরপর কী হয়? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে অসাধারণ এই বইটি পড়তে হবে। সবাইকে বিশেষ করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জননীদের জন্য বাস্তবধর্মী এ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসটি পড়ার আমন্ত্রণ থাকল।
প্রধান চরিত্র শ্যামা । তাই আমি আমার লেখনীতে তাকে প্রিয় চরিত্রে আসনে বসাতে চায় না। শ্যামা চরিত্র নিঃসন্দেহে সবার পছন্দের একটি জায়গা । যা জননী গল্পের প্রাণ এনে দিয়েছে কিন্তু আমার কাছে বিধানের চরিত্রটি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য এবং সুনিপুণ মনে হয়েছে।
উপন্যাসঃ জননী
লেখকঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
সঙ্কলনেঃ মাসুম আজাদ